মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১১:০৬:৫৬

‘জিকির করে কে’- প্রশ্ন করতেই গুলি

‘জিকির করে কে’- প্রশ্ন করতেই গুলি

নিউজ ডেস্ক :  গভীর রাতে অভিযানের সময় বাড়িটিতে ঢুকেই দেখা যায় পাশাপাশি চারটি কক্ষ। এর একটি কক্ষে মসজিদের ফ্লোরে মশারি টানিয়ে শুয়ে ছিলেন ওই মসজিদের ইমাম ইউসুফ। পাশের আরো তিনটি কক্ষের দরজা তখন ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। এর একটির দরজায় ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে এক নারী দরজা খোলেন। তখন পাশের একটি ঘর থেকে জিকির শোনা যাচ্ছিল। এ সময় ‘জিকির করে কে’—জানতে চাইতেই ভেতর থেকে গুলি ছোড়া হয়।

তখন ওই নারী ও তাঁর স্বামী ইউসুফ এবং সঙ্গে থাকা দুই শিশুকে বের করে নিরাপদে নেওয়া হয়। ভেতর থেকে জিকিরের শব্দে মনে হয়েছিল কেউ তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতে উঠেছে। কিন্তু যখন তাকে বের হয়ে আসতে বলা হয়, তখনই গুলির শব্দ পাই আমরা। এভাবে গত রবিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত রাজধানীর মোহাম্মদপুরসংলগ্ন বসিলা আবাসিক এলাকার একটি সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান চালিয়ে র‌্যাব দুজনের ছিন্নভিন্ন লাশ উদ্ধার করেছে। র‌্যাব এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন বসিলা’।

গতকাল বিকেল ৪টার দিকে অভিযান শেষ করে ঘটনাস্থলের বর্ণনা দিতে গিয়ে র‌্যাব দাবি করেছে, নিহতদের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। তবে বাড়ির কেয়ারটেকারসহ অন্যদের তথ্য মতে, নিহত দুজনের নাম সুমন ও সুজন। তারা দুজনই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য। তারা ভ্যানচালক ও বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে টিনশেড বাড়ির একটি রুম ভাড়া নিয়েছিল।

বাড়ির মালিক আব্দুল ওয়াহাব বর্তমানে র‌্যাব হেফাজতে। তাঁর বরাত দিয়ে র‌্যাব দাবি করেছে, ‘গত ১ এপ্রিল সুজন ও সুমন নামে ওই দুজন চারকক্ষের বাড়ির একটি কক্ষ ১৫০০ টাকা মাস হিসেবে ভাড়া নেয়। তবে তারা নিয়মিত বাসায় থাকত না। বাসাটি ভাড়া নেওয়ার সময় তাদের মধ্যে একজন নিজেকে ভ্যানচালক এবং অপরজন নিজেকে বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয় দেয়। তবে ভাড়া নেওয়ার সময় তারা জাতীয় পরিচয়পত্রের কোনো কপি বাড়ির মালিককে দেয়নি। প্রথমে ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হবে না জেনে পরে নিজেদের বিবাহিত পরিচয় দেয় দুজন। তখন তারা জানায় দুজনের স্ত্রী দু-এক দিনের মধ্যে আসবে। তদের কাথামতো তারা স্ত্রীদের আর আনেনি।

গতকাল সোমবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে অভিযানের একপর্যায়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ওই বাড়িটি ছিল জঙ্গি আস্তানা। অভিযান শেষে ঘটনাস্থল থেকে তিনটি পায়ের নমুনা পাওয়া গেছে। তবে তাদের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। যারা জঙ্গিবাদে ঝুঁকেছে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আহ্বান জানিয়ে র‌্যাব ডিজি বলেন, ‘লোকজন যদি জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত হয় সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানাবেন। এরা দেশ ও ইসলামের দুশমন। মুসলমানের দুশমন।’

র‌্যাব-২-এর কম্পানি কমান্ডার মহিউদ্দীন ফারুকী বলেন, রবিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে বসিলার ৮ নম্বর রোডের শেষ মাথায় একটি টিনশেড আধাপাকা বাড়িতে জঙ্গি আস্তানার খবর পাওয়া যায়। এরপর বাড়িটি ঘিরে ফেলা হয়। ভোর পর্যন্ত প্রায় দেড় শ রাউন্ড গুলিবিনিময় হয় বাড়িটিতে অবস্থানকারী জঙ্গিদের সঙ্গে। এর মধ্যে রাত সাড়ে ৩টার দিকে একটি এবং ভোর ৫টার দিকে আরো একটি—বড় ধরনের বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। এ সময় ওই বাড়ির টিনের চাল উড়ে যায়। সকাল ৯টার পর বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে র‌্যাবের স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা ওই বাড়িতে ঢোকে। পরে ড্রোন উড়িয়ে ভেতরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। অভিযানের একপর্যায়ে ওই বাড়িতে আগুন ধরে যায়। তখন ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির মালিক আব্দুল ওহাব, তত্ত্বাবধায়ক সোহাগ ও তাঁর স্ত্রী মৌসুমি এবং ওই বাসার পাশে কিছুদিন আগে গড়ে তোলা একটি মসজিদের ইমাম ইউসুফকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।

র‌্যাব-২-এর পরিচালক আশিক বিল্লাহ বলেছেন, অভিযানের সময় হ্যান্ডমাইকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে তিনটি বিদেশি পিস্তল, অবিস্ফোরিত চারটি ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ (আইইডি) উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। নিহতদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।

সরেজমিন : গতকাল সকালে বসিলা ব্রিজ পার হয়ে মেট্রো হাউজিং প্রপার্টির আট নম্বর রোডে ঢুকতেই মানুষের মুখে মুখে জঙ্গি আস্তানার কথা শোনা যায়। এরপর সড়কটি ধরে সামনে আগাতেই একটি তিনতলা বাড়ির সামনে র‌্যাবের ব্যারিকেড দেখা যায়। বিকেল ৩টার দিকে সড়কের শেষ মাথায় গিয়ে চোখে পড়ে একটি খাল। তার তীরেই একটি আধাপাকা টিনশেড বাড়ি। তার গায়ে টানানো একটি নেমপ্লেটে লেখা ছিল, ‘আল ওয়াহাব জামে মসজিদ হাফেজি মাদরাসা।’ তখন র‌্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা সেখানে ছিল। ওই বাড়িতে ঢুকে দেখা যায়, আগুনে পোড়া ছড়ানো-ছিটানো বিভিন্ন জিনিসপত্র পড়ে আছে। মসজিদের ভেতরে চট বিছানো। পাশের কক্ষে একটি ফ্রিজ, র‌্যাকে সাজানো থালা-বাটি, হাঁড়ি-পাতিলসহ কাঁথা-বালিশ ছিল। তবে সবই পোড়া। বাড়িটির সামনে একটি পেঁপেগাছ, একটি মেহগনি ও একটি ছোট আমগাছ। পাশের দেয়াল লাগোয়া পানির ট্যাংকের পাশে মসজিদের অজুখানা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই বাড়িটি রায়েরবাজার বধ্যভূমির ঠিক পেছনে। বধ্যভূমির পাশেই র‌্যাব-২-এর নতুন সদর দপ্তর। সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বসিলা মেট্রো হাউজিং এলাকার ওই বাড়িটি অবস্থিত। বাড়িটির ডানে-বামে আরো আনেকগুলো আধাপাকা টিনশেড ঘর। তার পাশেই একটি দোতলা ভবন। তবে বেশির ভাগ প্লট ফাঁকা। হাউজিংয়ের বেশির ভাগ বাড়ি নির্মাণাধীন।

পেছনের একটি বাড়ির বাসিন্দা মিন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, রাতে তাঁরা ঘুমিয়েছিলেন। গভীর রাতে র‌্যাব সদস্যরা এসে বলেন, সামনের বাড়িতে জঙ্গি আছে। সেখানে অভিযান চলছে। এ ছাড়া ওই এলাকার বাসিন্দা মিঠু ও আব্দুর রহিমসহ আরো অনেকের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়।

৮ নম্বর সড়কের বায়তুন নূর জামে মসজিদের ইমাম বলেন, বাড়ির মালিক ওহাব ওই জায়গা মসজিদের নামে দান করে দিয়েছিল। আসলে সরকারি খাসজমিতে ওহাব ঘর তুলেছিল।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, কিছুদিন আগে ওহাবের ওই জমিতে বিআইডাব্লিউটিএ অভিযান চালায়। এরপর সেখানে মসজিদ করে ওয়াহাব। সে মূলত এলাকায় ডিশ টিভির কানেকশন ও ইট-বালুর ব্যবসা করত।
সূত্র: কালের কণ্ঠ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে