আবুল কালাম আজাদ: ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংস্তুপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।’
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় শিশুদের জন্য পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার করেন বহুকাল আগে। কিন্তু আমাদের দেশে লাখো ছিন্নমূল পথশিশু আছে যারা অনাদরে-অবহেলায় দিন কাটায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত তারা।
বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও জরিপ নেই। কেউ বলেন ২০ লাখ। আবার কেউ বলেন ২৫ লাখ। ঢাকা শহরে আছে কমপক্ষে ৬ থেকে ৭ লাখ। তবে এদের মধ্যে ৫০ হাজার শিশু আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় থাকে। ফেলে দেয়া খাবারেই তাদের ক্ষুধা মেটে। আর ফেলে দেয়া জিনিসপত্র সংগ্রহ ও বিক্রি করাই তাদের প্রধান পেশা।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রামের (সিপ) ‘পথশিশুদের অমানবিক জীবন ও বিভিন্ন সমস্যা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনও বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনও ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না।
একই গবেষণায় বলা হয়, ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু কোনও একটি নির্দিষ্ট স্থানে সর্বোচ্চ ছয় মাস থাকে। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশু স্থান পরিবর্তন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে আর ৩৩ শতাংশ পাহারাদারের কারণে। খোলা আকাশের নীচে ঘুমানোর পরও তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিশুকে মাসিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নৈশপ্রহরী ও মাস্তানদের দিতে হয়। তারা পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেফতারেরও শিকার হয়।
জানা যায়, পথশিশুদের বড় একটি অংশ আসে দরিদ্র ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’ থেকে। দারিদ্র্যই মূল কারণ। বাবা-মায়ের বহু বিবাহও একটি কারণ। তার সাথে যুক্ত হয় নদী ভাঙন, ভূমিহীনতা ও জলবায়ুর পরিবর্তন।
আন্তর্জাতিক শিশু সনদ, শিশু আইনসহ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিটি শিশু তাদের সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভের জন্য শিক্ষা, খেলাধুলা, খাদ্য ও পুষ্টি ও বিনোদন পাওয়ার অধিকার রাখে। শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে এসব সনদ ও আইনে। কিন্তু আমাদের দেশের পথশিশুরা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত।
সরকারকে এখন এসব পথশিশুর কথা নতুন করে ভাবতে হবে। শিশুরা যাতে আর পথে বসবাস না করে, তার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। কাজটি অত্যন্ত দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি, আন্তর্জাতিক সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও ব্যক্তি সবাই মিলে একযোগে করলে এ দুরূহ কাজটি সম্ভব হবে।
শুধু দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যমে শিশুদের পথে জীবন যাপন করা থামানো যাবে না। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। দৃঢ় করতে হবে পারিবারিক বন্ধন। তবেই পথশিশুমুক্ত হবে দেশ।