নারায়ণগঞ্জ: ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে মেঘনা ও মেঘনা-গোমতি সেতুর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। নেই চিরচেনা যানজটে আটকে থাকা শত শত যানবাহনের দীর্ঘ সারি। যেখানে হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিরসনে গলদগর্ম সময় কাটাতো সেখানে হাইওয়ে বা ট্রাফিক পুলিশ নিরবে নিভৃতে দাড়িয়ে আছে। নেই কোন ব্যস্ততা বা বাঁশির সাইরেন।
মহাসড়কের আষাঢ়ীয়ার চর ব্রীজের দুপুর ২টা সময় দেখা যায়, সড়কে নেই কোন যানজট। নেই কোন বাধা। বাধাহীনভাবে চলছে যানবাহনগুলো। হাইওয়ে পুলিশের মধ্যেও যানজট নিরসনের তৎপরতা নেই। সোনারগাঁওয়ের দ্বিতীয় মেঘনা ও কুমিল্লার দাউদকান্দিতে দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য গত শনিবার উন্মুক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সেতু দুটি উদ্বোধন করেন ।
সরেজমিন মহাসড়কে গিয়ে দেখা যায়, সেতু উদ্বোধনের পর পাল্টে গেছে মহাসড়কের দৃশ্যপট। যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়েছে যাত্রী ও যানবাহন চালকদের, সেখানে বাধাহীনভাবে চলছে গাড়ি। উদ্বোধনের দ্বিতীয় দিনে চিরচেনা যানজটের দৃশ্য আর নেই। ফলে সহজেই গন্ত্যব্যে পৌঁছাতে পারছেন যাত্রীরা। মেঘনা সেতু মাত্র ৬ মিনিটে পার হওয়া যাচ্ছে বলে পরিবহন চালক ও যাত্রীরা জানিয়েছেন। এদিকে সেতু দুটি খুলে দেয়ায় এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে অনেকে ভীড় জমিয়েছেন সেতু দুটিতে। অনেকে সেতুতে এসে সেলফি তুলছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চার লেন বিশিষ্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে যানবাহন এসে আগে উঠতো এক লেন বিশিষ্ট সেতুতে। তাছাড়া পুরাতন সেতু বেশি ঢালু হওয়ায় ধীরগতিতে যান চলাচল করতো। ফলে সরকারি ছুটির দিনে গাড়ির চাপ বেশি হলে তীব্র যানজট লেগে থাকতো। তাছাড়া মাল বোঝাই ট্রাক বিকল হলে তো কথাই নেই। যানজটে আটকা পড়ে দীর্ঘ সময় চলে যেতো। এতে করে ভোগান্তি পোহাতে হতো যাত্রী ও চালকদের। কিন্তু এবার ঈদের আগে দ্বিতীয় মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতু খুলে দেওয়ায় মানুষের ভোগান্তি কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মেঘনা ও মেঘনা গোমতি সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক শওকত আহমেদ মজুমদার জানান, ১ হাজার ৪১০ মিটার দৈঘ্য ও ১৭ দশমিক ৭৫ মিটার প্রস্থ দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতি সেতু ১৬টি পিয়ার ও দুই পাশে দুটি এপাটমেন্টের উপর নিমাণ করা হয়েছে। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া পুরাতন মেঘনা-গোমতি সেতু পুনর্বাসনের জন্য ব্যয় হবে ৪০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় মেঘনা সেতুর দৈঘ্য ৯৩০ মিটার। ১১টি পিয়ার ও দুটি এপাটমেন্টে জয়েন্টের উপর নির্মিত দ্বিতীয় মেঘনা সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। পুরাতন মেঘনা সেতু পুনর্বাসনের জন্য ব্যয় হবে আরো ৪০০ কোটি টাকা। মোট ব্যায় হবে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
সেতুর ঢাকা প্রান্তে প্রায় ১ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম প্রান্তে ১ কিলোমিটার এ্যাপরোজ সড়ক এবং পশ্চিম পাশে সেতুর নীচ দিয়ে ৫০৭ মিটার দৈঘ্য সার্ভিস রোড নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় কাচঁপুর, দ্বিতীয় মেঘনা এবং দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণ এবং পুরাতন তিনটি সেতুর পুনর্বাসনসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে চুক্তি হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। প্রায় ৭ মাস আগে নতুন ৩টি সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই প্রথম কোন বড় প্রকল্প নিদিষ্ট সময়ে আগে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ব্যয়ও সাশ্রয় হয়েছে। এটি বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি মাইফলক হয়ে থাকবে।
তিনি আরো বলেন, এটি সম্ভব হয়েছে দুটি কারণে সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রনালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মনিটরিং এবং জাপানের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও তাদের কর্মদক্ষতার কারণেই সম্ভব হয়েছে।
শ্যামলী পরিবহনের চালক এজাজুল্লাহ সাঈদ জানান, মহাসড়কে ঈদে যানজটের কোন আশঙ্কা নেই। মেঘনা ও দাউদকান্দি সেতু খুলে দেওয়ায় যানজট ছাড়া সহজেই চলাচল করতে পারছি। টোল দিয়ে সেতুতে উঠতে এক লেন ব্যবহার করতে হতো। ফলে গাড়ির চাপ বেশি হলে ধীর গতিতে গাড়ি চলতো। এখন চার লেনে গাড়ি চলছে। তাই যানজটের কোন কারণ দেখছি না।
সাদ্দাম কাভার্ড ভ্যান চালক মোক্তার হোসেন জানান, আগে মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতু পার হতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগতো। কিন্তু নতুন সেতু দুটি খুলে দেওয়ার পর ছয় মিনিটে সেতু পার হওয়া যাচ্ছে।
সোহাগ পরিবহনের যাত্রী সৈয়দ আশেকুল ইসলাম জানান ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যেন বিদেশের কোন এক সড়ক। বিদেশী সড়কের মতো এখন যানজট নেই। মুক্তভাবে চলাচলের মহাসড়ক এটি। আগে এ সেতু পার হতে ভোগান্তিতে পড়তে হতো। অসহ্য যন্ত্রনাও সইতে হতো আমাদের। এখন আর সেই দুর্ভোগ নেই। সহজে পথ চলা যাচ্ছে।
ট্রাকের চালক আসাবুদ্দিন জুয়েল জানান, এই দুটি সেতুর উপরে এবং এ্যাপরোজ সড়কে প্রতিটি বন্ধের দিন এবং উৎসব পাবনে যানজট নিরসন করতে গিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের হিমসিম খেতে হতো। কিন্তু এবার সেতু দুটি খুলে দেয়ায় আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের ও ডিউটি কমে আসবে।
দ্বিতীয় মেঘনা সেতু ঘুরতে এসেছেন সোনারগাঁওয়ে ইসলামপুর এলাকার দুম্পতি সায়লা বেগম ও নরুনবী চৌধুরী। তারা বলেন, সেতুতে এসে খুব ভাল লাগছে। সেতু নির্মাণ শৈলী খুব চৎমকার। সড়কে যে যানবাহন চলাচল করতে তা মনেই হচ্ছেনা। এছাড়া আগের সেতুতে অনেক জয়েন্ট ছিলো এই সেতুতে তা নেই। বেশ কিছুক্ষন সময় কাটালাম, নদীর বাতাসের সাথে সেতুতে দাড়িয়ে সেলফী তুলাম ।
মেঘনা সেতুতে দায়িত্বপালনকারী পুলিশের কনস্টেবল ফরিদ মিয়া জানান, গত ঈদে এই সেতুতে ডিউটি করেছি। যানজট নিরসন করতে গিয়ে আমাদের খুব কষ্ট করতে হয়েছে। এক মিনিটের জন্য রাস্তায় পাশে দাড়ানোর সুযোগ মিলেনি। সারাক্ষণ হ্যান্ডমাইকে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে হয়েছে। কিন্তু আজ রোববার নতুন সেতু দুটি খুলে দেয়া পর প্রায় ৫ ঘন্টা ধরে মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করছি। গাড়ি এক মিনিটের জন্য কোথাও দাড়াচ্ছেনা। নেই চিরচেনা যানজটের দৃশ্য। দায়িত্ব পালন করতেও কোন কষ্ট হচ্ছেনা। আশা করি এবার এই ঈদে মহাসড়কে সেতুর কারনে কোন যানজট হবেনা।
কাচঁপুর হাইওয়ে পুলিশের (ওসি) কাইয়ুম আলী সরদার জানান, সেতুর দুটি উদ্বোধন হওয়ায় মহাসড়কের যানজটের কোন আশংকা নেই। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ স্বস্তিতে এবার ঈদে বাড়ি ফিরতে পারবেন। হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশকে গত বছর কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। এবার চারলেন বিশিষ্ট দ্বিতীয় মেঘনা ও গোমতি সেতু খুলে দেয়ায় আমাদের পরিশ্রম কম হবে।