নিউজ ডেস্ক : ক্যাসিনো ডন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট বিদেশের দুই ব্যাংকে অন্তত ৮০ কোটি টাকা জমা রেখেছেন। এছাড়া সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় তার রয়েছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট দেশের ব্যাংকে অর্থ রেখেছেন কিনা এর সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। বিষয়টি সম্রাট এড়িয়ে যাচ্ছেন। দেশের ব্যাংকে অর্থ নেই এমন দাবিও তিনি করছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জার্মানির একটি ব্যাংকে ও সুইজারল্যান্ডের একটি কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে অর্থ জমা রেখেছেন সম্রাট। অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও স'ন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি যে বিপুল অর্র্থ আয় করতেন তার একটি অংশ এসব ব্যাংকে জমা রাখতেন।
এছাড়া সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোতে তিনি কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ উড়িয়েছেন। সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে স্যান্ডস’র ক্যাসিনো স্বর্গে একমাত্র বাংলাদেশি পাইজা চেয়ারম্যান ছিলেন সম্রাট। হুন্ডিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অবৈধ আয়ের অর্থ সম্রাট বিদেশে পাচার করতেন। তদন্ত সূত্রের দাবি জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট বিদেশে অর্থ থাকার বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি কিভাবে সেই অর্থ বিদেশে পাচার করতেন। কারা তা দেখভাল করতো এসবও স্বীকার করেছেন। তদন্ত সূত্র জানায়, সুইজারল্যান্ডে ওই টাকার দেখভাল করেন পল্টনের একসময়ের যুবলীগের নেতা সুইজারল্যান্ড প্রবাসী আশরাফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। আশরাফুল পল্টনের ওয়ার্ড কমিশনার মোস্তফা জামানের একসময়ের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। সম্রাটের সঙ্গে মোস্তফার সম্পর্কের সূত্র ধরেই আশরাফুল ওই টাকার দেখভাল করতেন। জিজ্ঞাসাবাদে ব্যাংক এশিয়াসহ দেশের মোট ৫ টি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে বলে সম্রাট জানান। ওই অ্যাকাউন্টগুলো তিনি তার স্ত্রী ও মায়ের নামে খুলেছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত ওই ৫ টি অ্যাকাউন্টে তার উল্লেখযোগ্য টাকা নেই বলে তিনি দাবি করেছেন। গোয়েন্দারাও কোন বড় অর্থের সন্ধান পাননি। সব অ্যাকাউন্টগুলোর লেনদেনের নথিগুলো পর্যালোচনা করছেন র্যাবের মাঠ পর্যায়ের তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
এর আগে ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার খালেদ মাহমুদ ভূইয়া, আরমান, লোকমান হোসেন ভূইয়াও বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচারের কথা স্বীকার করেন। সূত্র জানায়, র্যাবের জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে রিমান্ডে থাকা সম্রাট ও আরমানকে মুখোমুখি করা হয়। এসময় তারা নিজেদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য একে অপরকে দোষারোপ করেছেন।
গত ১৫ই অক্টোবর অস্ত্র ও মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ মামলায় ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে ১০ দিন ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সভাপতি আরেক ক্যাসিনো কিং এনামুল হক আরমানকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি দেন আদালত। পরে মামলার তদন্তভার র্যাবে হস্তান্তর হলে তাদের র্যাব হেফাজতে নেয়া হয়। তাদের দুইজনকে র্যাবের জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ওই সেলের কর্মকর্তারা পালাক্রমে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। সম্রাটের জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-১ এর অধিনায়ক এবং র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম গতকাল দুপুরে মানবজমিনকে জানান, সম্রাটকে তার অতীতের সকল বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। তার তথ্যের সূত্র ধরেই তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট স্বাভাবিক রয়েছেন বলে তিনি জানান।
র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সম্রাটকে র্যাব-১ এর হেফাজতে নেয়ার পর গোয়েন্দারা তার আর্থিক বিষয়টি খোঁজ নেয়ার জন্য মাঠে কাজ করা শুরু করেন। বাংলাদেশের ব্যাংক এশিয়াসহ তার ৫ টি ব্যাংকে আক্যাউন্টের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু, এখন পর্যন্ত সেই ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য টাকা লেনদেনের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয় গোয়েন্দাদের। এ বিষয়টি সম্রাটকে জিজ্ঞাসা করেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তিনি একাধিকবার টাকা রাখার বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও একপর্যায়ে বিদেশের দুইটি ব্যাংকে তার টাকা রয়েছে বলে স্বীকার করেন।
সূত্র জানায়, জার্মানির একটি ব্যাংকে ৩৬ কোটি টাকা রেখেছেন সম্রাট। আর সুইজারল্যান্ডের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রেখেছেন ৪৪ কোটি টাকা। সুইস প্রতিষ্ঠানে রাখা অর্থ দেখভালের দায়িত্বে থাকা আশরাফুলের নামে পল্টন, মতিঝিল ও রমনা এলাকায় তার নামে হ'ত্যাসহ ১২ টি মামলা রয়েছে। পুলিশি হয়রানি ও মামলার ভয়ে তিনি ২০১২ সালের জুলাই মাসে দেশ ছেড়ে লিবিয়ায় শ্রমিক ভিসায় চলে যান। সেখান থেকে সাগরপথে ইতালি হয়ে সুইজারল্যান্ডে বসবাস করছেন। তিনি ওই দেশের নাগরিকত্বও পেয়েছেন বলে র্যাব নিশ্চিত হয়েছে। র্যাবসহ আইন-শৃংখলা বাহিনীর শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পরই পল্টনের কাউন্সিলর মোস্তফা জামান গাঢাকা দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, সম্রাট বিদেশের ব্যাংকে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে হুন্ডি ও ওয়েস্টা ইউনিয়নের আশ্রয় নিয়েছেন। সম্রাটের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বেশী পাঠাতেন আরকে মিশন রোডের গোপীবাগের আকবর হোসেন। তিনি মতিঝিল থানার সেচ্ছাসেবক লীগের নেতা। মতিঝিলের ক্যাসিনো হাটে তার আনাগোনা ছিল। আকবরসহ মতিঝিল পাড়ায় অবৈধ একাধিক হুন্ডি ব্যবসায়ীর চক্র গড়ে উঠেছিল। তাদেরও আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে র্যাব।
র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের সূত্রে জানায়, সম্রাটকে জিজ্ঞাসাবাদে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানতে পারেন যে, ক্যাসিনো টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আরমান ও খালেদের মধ্যে ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দুইজনই সম্রাটের আস্থাভাজন হওয়ার কারণে তিনি কোন পক্ষই নেননি।
সূত্র জানায়, প্রত্যেক মাসে একবার করে সিঙ্গাপুরে ক্যাসিনো খেলতে যেতেন সম্রাট। র্যাবকে তিনি জানিয়েছেন এটা তার নেশা ছিল। সিঙ্গাপুর শহরে তার একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়াও মালেশিয়ার পূত্রাজায়ায় ‘কুইক রোডে’ তার একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। সিঙ্গাপুরে বেশি যাওয়া আসা করায় প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের মালয়েশিয়ার ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দেয়ার চিন্তা করছিলেন সম্রাট।
এদিকে সম্রাট ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ পথে যে অর্থ আয় করতেন তা থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ অনেকে ভাগ পেতেন। সম্রাট কাদের অর্থ দিতেন এ তথ্য তিনি প্রকাশ করছেন। এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে তিনি কিছু নামও বলেছেন। এর মধ্য ঢাকার একজন সংসদ সদস্যকে মাসে চার লাখ টাকা করে দিতেন বলে জানিয়েছেন। এছাড়া নির্ধারিত এ অর্থ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে মোটা অংকের অর্থ নিতেন এ সংসদ সদস্য। উৎসঃ মানবজমিন