নিউজ ডেস্ক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা জোগাড় হয়নি তাই ইটভাটায় দিনমজুরি করছে পিতৃহীন অদম্য মেধাবী কাজল হোসেন। কাজল হোসেন চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে পারেনি সীমাহীন দারিদ্র্যের কষাঘাত। ইটভাটায় কামলা খেটেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে সে।
জানা গেছে, কুমারী গ্রামের মৃত আয়ুব আলীর ৩ ছেলের মধ্যে সবচে’ ছোট ছেলে কাজল। ৩ কাঠা মাত্র বসতবাড়ির ভিটে আছে। মাঠে নেই এক কড়াকান্তি আবাদি জমিজিরাত। বাপ আয়ুব হোসেনের দিনমজুরির টাকায় সংসার চলতো ধুকে ধুকে। এরই মাঝে কাজলের বয়স যখন সবে মাত্র ৫ বছর। আকস্মিক আকাশ ভেঙে পড়ে তাদের মাথায়! হঠাৎ সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় আয়ুব আলীর। কাজলের তখনও বাপের অভাব উপলব্ধির বয়স হয়নি। কিন্তু বিধবা মা ও বড় দুই ভাই ঠিকই বোঝেন নিদারুণ দারিদ্র্যের স'র্বগ্রা'সী ছোবলজ্বালা। ৩ ছেলের পাতে দুবেলা শাক-ভাত তুলে দিতে যে মা চোখে আঁধার দেখেন, শিশু সন্তান কাজলের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ দেখে সেই মা সাহস করে গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে এলাকার সকলকে বিস্ময়ে হতবাক করে সে জিপিএ ৫ অর্জন করে। সাথে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি। সেই থেকে শুরু কাজলের আকাশছোঁয়ার দুঃসাহসিক স্বপ্ন দেখার।
প্রাইমারির গণ্ডি পার হতে না হতেই বড় দুই সহোদর মতিয়ার রহমান ও আতিয়ার রহমানের বিয়ে হয়ে যায়। দরিদ্র পরিবারের সর্বগ্রাসী অভাবের তাড়নায় পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই ফিকে হয়ে আসে। জেএসসি পাসের আগেই বড় দুই ভাই পৃথক হয়ে যান। দুঃখিনী মাকে নিয়ে সদ্য কৈশোরে পা ফেলা কাজলের শুরু হয় অন্যরকম যুদ্ধ। একদিকে কচি হাতে অভাবী সংসারের হাল ধরার প্রাণান্তকর চেষ্টা, অন্যদিকে, লেখাপড়া শিখে বড় মানুষ হওয়ার দূরের স্বপ্নের হাতছানি। অথচ কাজলের সামনে একটা ছেড়ে আরেকটা দায়িত্বকে কাঁধে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এরই মাঝে মায়ের মুরগি-ছাগল বিক্রির টাকায় জেএসসি পরীক্ষা দেয়। এত নৈরাশ্যেও ২০১৩ সালে জেএসসি পরীক্ষায় সে জিপিএ ৫ অর্জন করে। তারপর জীবন তাকে আরো কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। সে একদিকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়, অন্যদিকে স্থানীয় এলআরবি ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে।
কাজল জানায়, লেখাপড়ার ব্যাপারে শিক্ষকরা সহযোগিতা করলেও খেয়ে-পরে বাঁচার ব্যাপারে কেউ সহযোগিতা করার ছিল না। ফলে ইটভাটায় কাজ শুরু করি। সারা বছর কাজ করার সুযোগ ছিল না। ইটভাটার কাজ হত শুধু শীতকালে। ২ শ টাকা মজুরিতে ইট তৈরির কারিগরের সহকারী হিসেবে কাজ করতাম। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাতে খুব বেশি পড়া যেত না, ঘুমিয়ে পড়তাম।
২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল কাজলের। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটে সে বছর তার পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। বছরজুড়ে ইটভাটা ও মাঠে শ্রমিকের কাজ করে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা জমিয়েছিল। তবে পরীক্ষার প্রস্তুতি যতেষ্ট না থাকলেও পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে। সামান্য ব্যবধানে জিপিএ ৫ পায়নি।
হারদী মীর শামসুদ্দীন আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম সাগর বলেন, জেএসসি পাস করার পর কাজল নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। একবছর পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে আবার বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনেন। সে অত্যন্ত মেধারী। সকলেই তাকে ভালবাসতেন।
এসএসসি পাসের পর আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয় সে। ভর্তির পর একদিকে সংসার চালানোর খরচ, অন্যদিকে লেখাপড়া ও তার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। ফলে আবার তাকে দিনমজুরির কাজ নিতে হয়। প্রায় ১ বছর দিনমজুর হিসেবে কাজ করার জন্য পড়ালেখায় মারা'ত্মক ক্ষতি হয়ে যায়। এরই মাঝে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে ওঠে সে। আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের কড়া নির্দেশে দিনমজুরির কাজ ছেড়ে পড়াশোনাতে মনোনিবেশ করতে বাধ্য হয় সে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গোলাম ছরোয়ার মিঠু বলেন, তিনি কাজলের মায়ের সাথে কথা বলতেন। বলতেন, একবেলা না খেয়ে থাকলেও পরীক্ষার আগ পর্যন্ত কাজল যেন দিনমজুরির কাজ না করে। দিনে কলেজ আর রাতে বাড়িতে পড়াশোনা করবে। কাজল জানায়, মাঝে মাঝে রাতে স্যার (অধ্যক্ষ) মোবাইলফোনে খোঁজ নিতেন লেখাপড়ার। তাতে কাজল আরো বেশি উৎসাহী হয়ে উঠত বলে উল্লেখ করে। কাজলের মা ময়ফুল খাতুন জানান, ডিম, হাঁস-মুরগি ও ছাগল পুষে বিক্রি করে ছেলের পরীক্ষার টাকা দিলাম। সবাই বলল তোমার ছেলে খুব ভালো পাস করেছে। এখন আবার ভর্তি পরীক্ষার জন্য টাকার দরকার।
এ বছর অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে সে জিপিএ ৫ অর্জন করেছে। এইচএসসি পাসের পর শুরু হলো আরেক যু'দ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধ। অর্থের অভাবে কাজল মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এ’ ইউনিটের মেধা তালিকায় ৩৯ নম্বর সিরিয়াল তার। তবে কাজল সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। সেখানে ভর্তির জন্য দরকার প্রায় ১৮ হাজার টাকা। কিন্তু ভর্তির পর শুরু হবে তার আসল যু'দ্ধ। কিভাবে ঢাকায় অবস্থান করে সে পড়বে? কাজল জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই জন্য যে ঢাকা শহরে ছোটখাট চাকরি অথবা প্রাইভেট পড়িয়ে যাতে নিজের পড়ার খরচ আর মায়ের জন্য কিছু কিছু পাঠাতে পারি। কিন্তু যতদিন কিছু করতে না পারছি, ততদিন আমি কিভাবে ঢাকায় থাকব আর মাকে কি পাঠাব?
ভবিষ্যতে কি হতে চাও এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কাজল জানায় যে, আল্লাহ চাইলে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চায়। তার এই স্বপ্ন বাস্তব করে তুলতে ভর্তির টাকা যোগাড় করতে এখন সে ইটভাটায় কাজ করছে। প্রতিদিন ৩ শ টাকা হিসেবে মজুরিতে। আগামী কয়েক দিনের ভেতর সে ঢাকায় যাবে ভর্তি হতে? কিন্তু কিভাবে যোগাড় হবে ঢাকায় অবস্থানের খরচ? সাথে প্রিয় মায়ের দিনাতিপাতের খরচ? এমন ভাবনায় যারপরনাই বিচলিত পিতৃহীন এই ছেলেটি। সূত্র : কালেরকণ্ঠ