বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন বুয়েটের ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী সাখাওয়াত ইকবাল অভি।
সোমবার (৯ নভেম্বর) ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালতে তিনি এ সাক্ষ্য দেন। এ নিয়ে মামলায় মোট ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলো।
জবানবন্দিতে প্রত্যক্ষদর্শী অভি বলেন, ‘২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর হোসাইন মােহাম্মদ তোহা আমাকে ও সাইফুল ইসলামকে ২০১১ নম্বর রুমে যেতে বলে। তখন আমি ভয় পেয়ে যাই। কারণ এই ঘটনার আনুমানিক ৭-৮ মাস আগে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ছাদে ১৬তম ব্যাচের অমিত সাহা আমাকে সালাম না দেয়ার অপরাধে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেঙে দিয়েছিল। তারপর আমি ও সাইফুল ইসলাম ২০১১ নম্বর রুমের দিকে যাই। সেখানে ১৬তম ব্যাচের মনিরুজ্জামান মনির, খন্দকার তাবাককারুল ইসলাম তানভির, ইফতি মোশাররফ সকাল, মুজতবা রাফিদ, ১৭তম ব্যাচের এহতেশামুল হক তানিম, এ এস এম নাজমুস সাদাত এবং হােসাইন মােহাম্মদ তােয়াকে খাটে বসে থাকতে দেখি।’
‘ওই সময় আবরার ২০১১ নম্বর রুমের মাঝখানে দাঁড়ানাে অবস্থায় ছিল। তখন আমি ও সাইফুল ইসলাম খাটে বসি। এরপর মুনতাসির আল জেমি আবারের দুইটি মােবাইল ফোন ও ল্যাপটপ নিয়ে ২০১১ নম্বর রুমে প্রবেশ করে। এরপর একটি মােবাইল ইফতি মোশাররফ সকাল ও অন্য মোবাইলটি মােস্তফা রাফিদ এবং ল্যাপটপটি মনিরুজ্জামান মনির, খন্দকার তাবাককারুল ইসলাম তানভির চেক করতে থাকে। এরমধ্যে ওই রুমে ১৭তম ব্যাচের মাের্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, সামছুল আরেফিন এবং মাজেদুর রহমান মাজেদ এবং ১৬তম ব্যাচের মুজাহিদুর রহমান প্রবেশ করে। এরইমধ্যে মােস্তফা রাফিদের সঙ্গে জেমি রুম থেকে চলে যায়।’
‘এরপর ইফতি মােশাররফ সকাল ওই রুমে থাকা আবরারকে জেরা করতে শুরু করে। বলে যে, তুই শিবির করিস কি-না? আবরার বলে, না, আমি শিবির করি না এবং আমি কখনাে এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। এরপর রাত ৯টার দিকে ১৫তম ব্যাচের অনিক সরকার, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন এবং মেহেদী হাসান রবিন ওই রুমে প্রবেশ করে।’
জবানবন্দিতে অভি বলেন, ‘মেহেদী হাসান রবিন আবরারকে জেরা করে বলে যে, শিবির করে কি-না? আবরার বলে, না, আমি শিবির করি না। এরপর রাত পৌনে ১০টার দিকে মেহেদী হাসান বিন আবরারের মুখে চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করেন। এরপর মােতাহুল ইসলাম জিয়ন আবরারের মুখে চড়-থাপ্পড় মারে। পরে ইফতি মোশাররফ সকাল আবরারকে চড়-থাপ্পড় মারে এবং জেরা করে যে, সে শিবির করে কি-না? তখন আবরার আবার বলে, আমি শিবির করি না। এ সময় ইফতি মােশাররফ সকাল ক্রিকেট স্ট্যাম্প আনতে বললে ১৭তম ব্যাচের কোনো একজন একটি ক্রিকেট স্ট্যাম্প ২০১১ নম্বর রুমে আনে। ওই স্ট্যাম্প দিয়ে ইফতি মােশাররফ সকাল আবরারের মারতে শুরু করে।’
‘আসামি ইফতি মােশাররফ সকাল আবরার ফাহাদকে মারতে মারতে ক্রিকেট স্ট্যাম্পটি ভেঙে দু’টুকরা হয়ে যায়। ক্রিকেট স্ট্যাম্পটি ভেঙে গেলে এহতেশামুল হক রাব্বি তানিম আরেকটি স্ট্যাম্প আনে। ওই ত্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে অনিক সরকার মারতে থাকে এবং আবরারকে বলে তুই স্বীকার কর যে, তুই শিবির করিস। এরপর আমি ভয় পেয়ে যাই। তখন আমি মনিরুজ্জামান মনিরকে বলি, ভাই আমি ভাত খেতে যাব। তখন অনুমতি পেয়ে আমি আর সাইফুল ইসলাম ২০১১ নম্বর রুম থেকে বের হয়ে যাই। এই ঘটনা কাউকে জানালে আমাকেও মারতে পারে। এজন্য আমি ঘটনা কাউকে বলি নাই।’
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার জেরে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ডেকে নেয় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন ৃনেতাকর্মী। এরপর রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের নিচতলা ও দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরদিন ৭ অক্টোবর দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে আবরারের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।
নিহত আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি।
ওই ঘটনায় নিহতের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান।
অভিযুক্ত ২৫ জনের মধ্যে এজাহারনামীয় ১৯ জন এবং তদন্তে প্রাপ্ত এজাহারবহির্ভূত ছয়জন রয়েছেন। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৬ জন এবং এজাহারবহির্ভূত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতারদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আটজন।
গ্রেফতার ২২ জন হলেন- মেহেদী হাসান রাসেল, মো. অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মেহেদী হাসান রবিন, মো. মেফতাহুল ইসলাম জিওন, মুনতাসির আলম জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভির, মো. মুজাহিদুর রহমান, মুহতাসিম ফুয়াদ, মো. মনিরুজ্জামান মনির, মো. আকাশ হোসেন, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মাজেদুর রহমান, শামীম বিল্লাহ, মোয়াজ আবু হুরায়রা, এ এস এম নাজমুস সাদাত, ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, অমিত সাহা, মো. মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, শামসুল আরেফিন রাফাত, মোর্শেদ অমত্য ইসলাম ও এস এম মাহমুদ সেতু।
মামলার তিন আসামি এখনো পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন- মোর্শেদুজ্জামান জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মোস্তবা রাফিদ। তাদের মধ্যে প্রথম দুজন এজাহারভুক্ত ও শেষের জন এজাহারবহির্ভূত আসামি।
১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এ সময় কারাগারে থাকা ২২ আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করে আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন।