সাড়ে তিন বছর বয়সী আনিসা টেবিলের ওপর বসা। তার মুখে মাস্ক। এক হাতে ক্যানুলা লাগানো। অন্য হাতে সে মেহেদি লাগাচ্ছে। আর তার হাতে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছেন অ্যাপ্রোন গায়ে দেওয়া চিকিৎসক শাদিয়া সিরাজ। তিনি ঢাকা শিশু হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার। আর আনিসা গত ৩১ মে থেকে করোনা পজিটিভ নিয়ে ভর্তি আছে হাসপাতালটির শিশু করোনা ইউনিটে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে আনিসা বায়না ধরেছিল—হাতে মেহেদি লাগাবে। আনিসার নানি জেসমিন বেগম মেহেদির টিউব কিনে এনেছিলেন। চিকিৎসক শাদিয়া সিরাজ আনিসার মন ভালো করার জন্যই ওর হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। আর এটা দেখে নানি জেসমিন বেগম নিজের মুঠোফোনে ছবিটি তুলে রেখেছিলেন। আর ছবি তুলেছেন দেখে শাদিয়া স্মৃতি হিসেবেই ছবিটি চেয়ে নিয়েছিলেন। পরে মেসেঞ্জার গ্রুপে বন্ধুদের সঙ্গে ছবিটি শেয়ার করেছিলেন। বন্ধুদের কয়েকজন শাদিয়ার মেহেদি লাগিয়ে দেওয়ার ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার দেন।
স্বজনেরাই অনেক সময় করোনা রোগীর কাছে যেতে চান না। সেই জায়গায় নিজে থেকেই এক চিকিৎসক ছোট একটি রোগীর হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছেন— ছবিটি দেখে তাই অনেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
চিকিৎসক শাদিয়া সিরাজ জানালেন, ছোট আনিসার জন্মগতভাবেই মলদ্বার নেই। পেটে ছিদ্র করা আছে, সেখান দিয়েই সে পায়খানা করে। এই জটিলতার জন্যই আনিসাকে ঢাকায় আনা হয়েছিল, সে অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিল। করোনায় আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকা শিশু হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি করা হয়। আজ আনিসাসহ এ ইউনিটে ভর্তি আছে আটটি শিশু।
শাদিয়া বললেন, ‘আমার নিজের মেয়ের বয়স চার বছর। এই ঈদেও মেয়ের হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিয়েছি। নিজে মা হওয়ার পর থেকে হাসপাতালে আসা শিশু রোগীদের জন্য অন্য রকম মায়া অনুভব করি। গতকাল দুপুরে আনিসা জামা গায়ে দিয়ে সুন্দর করে সাজুগুজু করে আমার টেবিলের কাছে আসে। ওর নানি জানান, মেহেদি দেওয়ার বায়না করছে। তা শুনে আমি নিজেই মেহেদির টিউব আনতে বলি এবং কাজের ফাঁকে ওর ছোট হাতে লাগিয়ে দিই। আমি এমনিতেই নিজে ছবি খুব কম তুলি। আনিসার নানি ছবি তুলেছেন দেখে করোনার স্মৃতি হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্য নার্সকে বলে ছবিটি আমার মুঠোফোনে সংগ্রহ করি। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করি। বন্ধুরাই তা ফেসবুকে শেয়ার করেন।’
আনিসার নানি জেসমিন বেগম জানান, আনিসার বাবা সৌদি আরব থাকেন। বর্তমানে ছুটিতে দেশে এসেছেন। মেয়ের স্বামী দেশে না থাকায় মেয়ে ও নাতনি বেশির ভাগ সময় তাঁর কাছেই থাকে।
জেসমিন বেগম বলেন, ‘ডাক্তার ম্যাডাম যখন আনিসার হাতে মেহেদি দিতেছিলেন, তখন খুব ভালো লাগতেছিল। ম্যাডাম আপন মানুষের মতোই মেহেদি লাগাইতেছিলেন। খুশি হয়েই ছবি তুলি।’
কথা প্রসঙ্গে জেসমিন জানালেন, তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তাঁর বিয়ে হয়। অসুস্থ ছিলেন, তাই এলাকার সবার পরামর্শে একমাত্র মেয়েকেও মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন। এক ছেলে পড়ছে নবম শ্রেণিতে। মেয়ের ঘরের নাতনি আনিসা। তবে ওর জন্মের পর থেকেই শুরু হয়েছে ভোগান্তি। এবারও কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন আনিসার মলদ্বার–সংক্রান্ত চিকিৎসার জন্য। তবে করোনায় এ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।
জেসমিন আরও বলেন, হাসপাতালটির করোনা ইউনিটের দায়িত্বরত চিকিৎসক-নার্সরা বাচ্চাদের অনেক আদর করেন। আনিসা চিকিৎসক-নার্সদের খালামণি ডাকে। শুধু সাদা পোশাক (পিপিই) পরে যখন ওয়ার্ডে যান, তখন আনিসা ভয় পায়।
চিকিৎসক শাদিয়া বললেন, ঢাকা শিশু হাসপাতালের করোনা ইউনিট চালু হয়েছে গত বছরের ১৪ জুলাই। ২০ শয্যার এ ইউনিট চালুর শুরু থেকেই তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। এ পর্যন্ত মোট ২৪৯টি শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়ে এ ইউনিটে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে মারা গেছে ১৪টি শিশু। করোনায় যারা মারা গেছে, তাদের জন্মগত হৃদরোগসহ অন্যান্য জটিলতাও ছিল।
শাদিয়া সিরাজ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, শিশুদের মধ্যেও করোনা বাড়ছে। মা–বাবা পজিটিভ হলে শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। করোনা ইউনিটে ১৮টি শিশুও একসঙ্গে ভর্তি ছিল। শুরুতে শিশুদের করোনা হলেও তেমন কোনো উপসর্গ ছিল না। তবে বর্তমানে অনেক বেশি জ্বর, কাশিসহ নানা উপসর্গ নিয়ে শিশুরা ভর্তি হচ্ছে।
শাদিয়া সিরাজ সন্তানকে বাইরে নেওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের একটু বেশি সতর্ক ও সচেতন থাকার পরামর্শ দেন। বাইরে গেলেও ঠিকমতো মাস্ক পরানো, বারবার শিশুর হাত ধুয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে বলেন।
শাদিয়া ঢাকায় তাঁর ৭৫ বছর বয়সী বাবা ও ৬৫ বছর বয়সী মায়ের সঙ্গে থাকেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে ইনেসার বয়স চার বছর। তাই শাদিয়াকেও সারাক্ষণই সতর্ক থাকতে হয়। হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ১৫ দিন দায়িত্ব পালন করার পর ১৫ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। করোনা পরীক্ষা করে নেগেটিভ ফল এলে আবার কাজে যোগ দিতে হয়। শাদিয়া জানালেন, এখন পর্যন্ত তাঁর করোনা পজিটিভ হয়নি।
শাদিয়া বললেন, ‘করোনা ইউনিটে বাচ্চাগুলোর কষ্ট দেখে তাদের থেকে খুব বেশি দূরে থাকার উপায় থাকে না। বাচ্চাগুলোর শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি মুখে মাস্ক লাগিয়ে রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিও মানতে হয়। তাই ওদের মন যাতে একটু ভালো থাকে, তার জন্য আমরা চেষ্টা করি।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘চিকিৎসা করতে করতেই অনেক বাচ্চা মারা যায়। কোনো অভিভাবককে তাঁর বাচ্চা মারা গেছে, এটা জানানো খুব কষ্টের কাজ। সব সময় চাই, মা–বাবার কাছে এই ঘোষণা যাতে আমাকে দিতে না হয়।’