রবিবার, ২৬ জুন, ২০১৬, ০২:১৯:২০

‘১০ মিনিটে শেষ সোনার সংসার’

‘১০ মিনিটে শেষ সোনার সংসার’

শেখ সাবিহা আলম: দুই সন্তানকে নিয়ে উত্তরার আলাউদ্দিন টাওয়ারে ইফতার মাহফিলে গিয়েছিলেন আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান। কিছুক্ষণ পর সেখানে গিয়ে স্ত্রী মেহবুবা হোসেন দেখলেন, আগুনে সব পুড়ে ছারখার। ছুটে গেলেন ঢাকা মেডিকেলে। পেলেন আগুনে পুড়ে যন্ত্রণায় কাতর স্বামী-সন্তানকে। কোনো মতে কষ্ট চাপা দিয়ে সারা রাত সেবা করলেন মেহবুবা। কিন্তু আর পারলেন না। গতকাল ভোরে স্বামীর মৃত্যুর পর সেই কষ্ট পরিণত হয়েছে এখন করুণ বিলাপে। আর্তনাদ করে বারবারই বলছিলেন, ‘১০ মিনিটে শেষ হয়ে গেল আমার সোনার সংসার।’

শুক্রবার উত্তরার আলাউদ্দিন টাওয়ারে আগুনে ও লিফট ছিঁড়ে পাঁচজন মারা যান। দগ্ধ হন ট্রপিক্যাল হোমসের উপমহাব্যবস্থাপক মাহমুদুল হাসান, তাঁর ১১ বছরের মেয়ে মাইশা আক্তার ও আট মাসের মুত্তাক্বীনসহ কয়েকজন। বাবা ও দুই সন্তানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে ভোর চারটার দিকে বাবা মাহমুদুল মারা যান। দুই সন্তান চিকিৎসাধীন। মাইশার শরীরের ৫৫ শতাংশ ও মুত্তাক্বীনের ২৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলছেন চিকিৎসকেরা। গতকাল বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায় বিলাপ করেই চলেছেন মাহমুদুলের স্ত্রী মেহবুবা। তিনি বলছিলেন, তাঁদের সবারই একসঙ্গে দাওয়াতে যাওয়ার কথা ছিল। পরে মাহমুদুল তাঁকে বলেন, তাঁর বাবা মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে পরে আসতে। এই বলে তিনি সন্তানদের নিয়ে বেরিয়ে যান। মিনিট দশেক পরই শ্বশুর কে নিয়ে মেহবুববা পৌঁছান আলাউদ্দিন টাওযারে। গিয়ে দেখেন আগুন জ্বলছে, ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে দোকানের জিনিসপত্র, জুতো, কাঁচের টুকরো।


মেহবুবা বলেন, হাসপাতালে আসার পর মেয়ে বারবার বাবার খোঁজ করেছে। ফোনে কথা বলেছে। পাশাপাশি বিছানায় ভাই-বোন শোয়া। মা কে বলেছে ছোট ভাইয়ের পাশে বসে থাকতে। বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন হোসাইন ইমাম বলেন, মাইশার অবস্থা সঙ্কটজনক। হাই ডিপেন্ডেসি ইউনিটে (এইচডিইউ) ভর্তি মাইশার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। গতকাল সকালে তার হাতে জরুরি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এ দুর্ঘটনায় মাহমুদুল হাসানসহ মৃতের সংখ্যা এখন ছয়। নিহত লোকজনের  তিনজন পুড়ে মারা গেছেন, বাকি তিনজন মারা গেছেন লিফট চাপা পড়ে। নিহত ছয়জন হলেন মিজানুর রহমান (৫২), মো. জসিমউদ্দীন (৩৫), কামরুন্নাহার লতা (৩০), সালমা আক্তার (৪০), রেজাউল ইসলাম (৩২) ও মাহমুদুল হাসান (৪৫)।


নিহত রেজাউল ইসলামও এসেছিলেন ইফতারের দাওয়াতে। গ্রামের বাড়ির বন্ধুবান্ধবরা দেখা করতে চেয়েছিলেন। এ দেখাই শেষ দেখা ভাবতেও পারেননি বন্ধু তৈয়বুর রহমান। তৈয়ব জানান, রেজাউলের স্ত্রী কানিজ ফাতেমার মস্তিষ্কে টিউমার হয়েছে। ভারত থেকে অস্ত্রোপচার করে এসেছেন সম্প্রতি, আবারও যাওয়ার কথা। রেজাউলের ১৫ মাস বয়সী একটি ছেলে আছে। ছেলেটি জন্মের পর থেকেই স্ত্রী অসুস্থ। আরও যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের সবাই কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালাতেন। সালমা আক্তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বুকের ওপর লিফট ছিঁড়ে পড়ে। একটি মেয়ে সম্মান তৃতীয় বর্ষে পড়ে, ছেলেটি কলেজে। স্বামী আনিসুর রহমান গাড়িচালক। ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে বাড়িতে বসে ব্যাগ বানাতেন, তারপর বিক্রি করতেন। ঘটনার দিন নামাজ পড়তে মার্কেটের নিচতলায় গিয়েছিলেন।


কামরুন্নাহার লতা দোকানে কাজ করতেন। ঢাকায় একটা ভাড়া করা কক্ষে  থাকতেন, বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। লতার লাশ নিতে এসে খালাতো ভাই হীরা মিয়া বলছিলেন, ওই আমার খালার ছেলে, ও-ই মেয়ে। আহত হয়েছেন খবর পেয়ে উত্তরার জাপান শিন শিন হাসপাতালে গিয়েছিলেন, তারপর শোনেন মারা গেছেন। টাওয়ারের নিরাপত্তারক্ষী মিজানুর রহমান আট বছর ধরে ওই ভবনেই চাকরি করেন, কষ্টের টাকা বাড়িতে পাঠাতেন। তাই দিয়ে চলত স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরণপোষণ। মো. জসিমউদ্দীন কাজ করতেন প্রসাধন সামগ্রীর দোকানে। বাড়িতে বিধবা মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান।-প্রথম আলো

২৬ জুন, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে