তোহুর আহমদ: ‘মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ যারা বাবুলকে জড়িয়ে নানা কথাবার্তা বলছেন তাদের বাড়িতে গিয়ে তদন্ত করা হোক। তাদের জীবন যাপন ও সম্পদের খোঁজখবর নেয়া হোক। একই সঙ্গে বাবুলের বাড়িতে গিয়ে তার সম্পদ ও আসবাবপত্র খতিয়ে দেখা হোক। এসব দেখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কারণ বাবুল একজন সৎ ও নির্লোভ পুলিশ অফিসার। তাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে এখন নির্মম ষড়যন্ত্রের শিকার।’ চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যাকাণ্ডের নানামুখী তথ্যে শুধু গণমাধ্যম কর্মীরা নয়, পুরো দেশবাসীই এখন বিভ্রান্ত। দিন যত যাচ্ছে ততই পাওয়া যাচ্ছে অবিশ্বাস্য রকম নানা তথ্য। তদন্তের শুরুটা জঙ্গি সন্ত্রাসীসহ বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডারদের মধ্যে ঘুরপাক খেলেও এখন তা ঢুকে পড়েছে খোদ মিতুর স্বামী এসপি বাবুল আক্তারের ঘরের মধ্যে। অনেকটা নিষ্ঠুর, নির্মম ও ঘৃণিত তথ্য হলেও খোদ পুলিশের নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে দিন কয়েক আগে দাবি করা হয়, মিতুর পরকীয়া ঠেকাতে বাবুল আক্তার নিজেই এ খুনের পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা।
একজন মৃত মানুষের চরিত্র হনন ছাড়াও অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না বলে কোনো কোনো গণমাধ্যম বিষয়টিকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করে। এর একদিন পর মঙ্গলবার আরও একটি দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়, মিতু নয়, পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন এসপি বাবুল আক্তার নিজেই। সেই মেয়ের সঙ্গে নির্বিঘ্নে সংসার পাততে বাবুল তার স্ত্রী মিতুকে এভাবে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। এজন্য তিনি তার রানার (ব্যক্তিগত বার্তাবাহক-পুলিশ কনস্টেবল) সাদ্দামের মাধ্যমে সোর্স মুসাকে দুই লাখ টাকা দিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, যেসব সূত্র থেকে এসব ভয়াবহ ও অবিশ্বাস্য রকম তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে তা কোনো সাধারণ সূত্রও নয়। সঙ্গত কারণে পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থেই তারা এসব তথ্য উপাত্ত দিচ্ছেন। এমনকি এও বলা হচ্ছে, এর সপক্ষে তাদের কাছে অনেক তথ্য প্রমাণও রয়েছে। এসপি বাবুল যার সঙ্গে পরকীয়া করেছেন সেই মেয়ের গ্রামের বাড়ি ফেনী। তাকেও নাকি জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এদিকে এই যখন অবস্থা তখন মঙ্গলবার একান্ত সাক্ষাৎকারে বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন পুরো বিষয়টিকে বানোয়াট ও মহল বিশেষের গভীর ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তার জামাতা শতভাগ নির্দোষ। একটি চক্র বাবুলকে চাকরি ছাড়া করতে এসব রটাচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা যদি মুখ খুলি তবে সব ষড়যন্ত্র উড়ে যাবে।’ হয়তো শেষ পর্যন্ত আমাদের মুখ খুলতেই হবে। ওদিকে সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য একটি মাধ্যমে এসপি বাবুল আক্তারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় যুগান্তর। বাবুল আক্তারের বরাত দিয়ে সূত্রটি জানায়, বাবুল আক্তার তাকে জানিয়েছেন, তিনি যদি পরকীয়া করে থাকেন তাহলে সেই মেয়ের নাম পরিচয় প্রকাশ করা হোক। পরকীয়া করে থাকলে নিশ্চয় তিনি ওই মেয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। কোথাও না কোথাও দেখা করেছেন। কেউ না কেউ তা দেখেও থাকতে পারেন। তাহলে সেসব প্রমাণ হাজির করা হোক।
এছাড়া তিনি জানিয়েছেন, একসঙ্গে বহু চাঞ্চল্যকর মামলা তদন্তের অভিজ্ঞতা আছে তার। একটি ডাকাতি ও অস্ত্র মামলার তদন্তে অন্যতম সোর্স ছিলেন মুসা। তাই তিনি যদি তার স্ত্রী মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করেই থাকেন তাহলে তার মতো একজন পুলিশ অফিসার কেন সোর্স মুসাকেই ব্যবহার করবেন? এছাড়া পরকীয়ার কারণে যদি স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য হয় তাহলে তাকে হত্যা করতে হবে কেন? সংসার না করলেই তো পারতেন। সর্বোপরি এ দাম্পত্য কলহের বিষয় গোপন থাকার কোনো সুযোগ নেই। কেউ না জানলেও তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন অবশ্যই জানতেন। কিন্তু তারা কি এসব কখনও শুনেছেন?
এসপি বাবুল যুগান্তরের সংশ্লিষ্ট মাধ্যমকে আরও বলেন, আসলে তার বিরুদ্ধে সেই ২০০৭ সাল থেকেই ষড়যন্ত্র চলে আসছে। তখনই তাকে একটি মহল শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তারা তা পারেনি। ওই চক্রের সঙ্গে এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রভাবশালী ব্যক্তি। যারা এসব নোংরা ও বানোয়োট কথা ছড়াচ্ছে। এসপি বাবুল আক্তারের প্রশ্ন- যারা প্রথমে বলেছিল মিতুর পরকীয়ার কারণে তিনি এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন তারা ওই ছেলের নাম বলুক, তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তো অনেক তথ্য জানার কথা। কিন্তু তারা তা করছে না কেন?
সূত্রটি জানায়, এরাই বাবুল আক্তারকে ওপর মহলের কথা বলে চাকরি ছাড়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বাবুল আক্তার মনে করেন, তিনি শতভাগ পরিষ্কার আছেন। বরং তার দুই সন্তানসহ তাদের গোটা পরিবারের শোকাবহ অবস্থার মধ্যে যারা এসব ঘৃণিত ষড়যন্ত্র করছেন তাদের মুখোশ একদিন উন্মোচন হবেই। তিনি বলেন, তার বড় ছেলে এখন মানসিকভাবে ট্রমাটাইজড। কেননা তার সামনেই খুনিরা তার মাকে হত্যা করেছে। এছাড়া সাড়ে ৩ বছরের ছোট্ট মেয়ে সারা দিন মা মা বলে আহাজারি করছে। ওদের মুখের দিকে তিনি তাকাতে পারছেন না। তিনি নিজেও বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় যারা এসব করছে নিশ্চয় সরকারের নীতিনির্ধারক মহল বিষয়টি গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখবে।
এদিকে মঙ্গলবার বিকালে এসপি বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন একান্ত সাক্ষাৎকারে যুগান্তরকে যা বলেছেন, তা হুবহু নিচে তুলে ধরা হল।
যুগান্তর : মিতু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আপনার জামাতা বাবুল আক্তারকে জড়িয়ে চারদিকে নানা কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। নিশ্চয় আপনিও কিছু শুনেছেন। এ বিষয়ে আপনাদের প্রতিক্রিয়া কী? মোশাররফ হোসেন : দেখুন, কে কী বলল তাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না। পত্রিকায় কী লেখা হল সেটা নিয়েও আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না। আমরা আরও কিছু সময় অপেক্ষা করব। এরপর যখন আমরা মুখ খুলব, তখন সব ষড়যন্ত্র উড়ে যাবে। মামলার আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) থেকে শুরু করে বড় বড় কর্মকর্তারও মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।
যুগান্তর : গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ যাচাই প্রশ্নে আপনি বাবুল আক্তারের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন কি?
মোশাররফ হোসেন : কেন বলব না। এক বাড়িতেই তো আছি। প্রতিদিনই কথা হচ্ছে। বারবারই আমি বলছি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, তা সুষ্ঠু তদন্তের জন্য মোটেও সহায়ক নয়। এখন তো পরিস্থিতি এমন, পারলে বাবুলকে গ্রেফতার করে ক্রসফায়ার দিতে পারলে তাদের ভালো হয়।
যুগান্তর : বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করতে আপনাদের ওপর কোনো চাপ আছে কি?
মোশাররফ হোসেন : না কোনো ধরনের চাপ নেই। তবে বাবুল যদি জড়িত থাকে তাহলে কাউকে চাপ দিতে হবে না। আমরাই তার বিরুদ্ধে মামলা করব।
যুগান্তর : বাবুলের সঙ্গে মিতুর দাম্পত্য জীবন কি খারাপ যাচ্ছিল?
মোশাররফ হোসেন : মোটেও না। তাদের মধ্যে একদিনের জন্যও কোনো ঝগড়া হয়েছে বলে শুনিনি। আর যদি আমার মেয়ের সংসারে কোনো ঝামেলা থাকত তবে সে তো আমাদের অবশ্যই বলত। কই কখনও তো বাবুলের বিরুদ্ধে সে কোনো অভিযোগ করেনি। এখন মেয়ের মৃত্যুর পর তার সংসারে অশান্তির কথা কোথা থেকে আসছে।
যুগান্তর : বাবুল কি আপনার কাছে কখনও যৌতুক বা উপহার হিসেবে কিছু দাবি করেছেন?
মোশাররফ হোসেন : আপনাদের একটা কথা বলি। আমার দুটো মেয়ে। একজনের জামাই ডাক্তার, অপরজন পুলিশ অফিসার। দু’জনেই ক্যাডার কর্মকর্তা। কিন্তু তাদের বিয়েতে একজনের ৭১ হাজার এবং আরেকজনের ৭৭ হাজার টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। তাহলে বুঝতে হবে সম্পদের লোভ থেকে তারা বিয়ে করেননি। তাহলে এতদিন পর তাদের যৌতুক চাইবার তথ্য কোত্থেকে আসছে? আর যৌতুক চাইলে তো আমার কাছেই চাইবে। কই আমার কাছে তো বাবুল কোনোদিন একটি টাকাও চায়নি।
যুগান্তর : নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র আমাদের জানিয়েছে, চট্টগ্রামে থাকাবস্থায় মিতু বাবুলের হাতে মারধরের শিকার হয়ে খুলশী থানার ওসি মোহসিনের বাসায় আশ্রয় নিতেন।
মোশাররফ হোসেন : বাজে কথা। খুলশী থানার ওসিকে জিজ্ঞেস করেন। তার বাসায় আমার মেয়ে একদিনও থেকেছে কি-না। এসব কথা কারা ছড়াচ্ছে, কেনই বা ছড়ানো হচ্ছে। আমার বাবুল যদি এতই খারাপ হবে তাহলে তার বিরুদ্ধে আগেই কেন স্ত্রী নির্যাতনের অভিযোগে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং বাবুলকে পাওয়ার জন্য বড় বড় পুলিশ কর্মকর্তারা মরিয়া হয়ে গেছেন। যখন ৭১ জন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বাবুলও এসপি হিসেবে পদোন্নতি পেল তখন তাকে পুলিশ সদর দফতর, ডিএমপি ও সিএমপি থেকে ডাকাডাকি করা হয়েছে। কে তাকে নিয়ে কাজ করবে রীতিমতো তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়েছে।
যুগান্তর : তথ্য এসেছে বাবুল তার সোর্সকে দিয়ে স্ত্রীকে খুন করিয়েছেন।
মোশাররফ হোসেন : তর্কের খাতিরে যদি আপনার কথা সত্যি বলে ধরেও নিই তাও বিষয়টি অসঙ্গতিপূর্ণ। কারণ, বাবুল একজন দক্ষ পুলিশ অফিসার। সে নিজেই অন্তত ৬০টি হত্যা মামলার তদন্ত করেছে। তাই সে যদি কোনো কারণে তার স্ত্রীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে খুন করার সিদ্ধান্তও নিয়ে থাকে তবে সে কেন নিজের ঘনিষ্ঠ সোর্সকেই ব্যবহার করবে? তার এটুকু কাণ্ডজ্ঞানও কি নেই? তাছাড়া কোনো পিতা তার শিশুসন্তানের সামনে কি তার স্ত্রীকে খুন করাতে চাইবে? আমি নিজে পুলিশ অফিসার ছিলাম। পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে আপনাকে বলতে পারি, খুনের ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের হত্যাকাণ্ডের পর একটা অপরাধবোধ তৈরি হয়। তখন সে অস্বাভাবিক আচরণ করে। যদি বাবুল এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকত তবে সে আমার বাড়িতেই বসে থাকতে পারত না।
যুগান্তর : তবে খুনের সঙ্গে বাবুলকে জড়িয়ে এসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে কেন?
মোশাররফ হোসেন : সে প্রশ্ন আমারও। আমি এখন কিছুই বলতে চাই না। শুধু বলব, মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ যারা বাবুলকে জড়িয়ে নানা কথাবার্তা বলছেন তাদের বাড়িতে গিয়ে তদন্ত করা হোক। তাদের জীবনযাপন ও সম্পদের খোঁজখবর নেয়া হোক। একই সঙ্গে বাবুলের বাড়িতে গিয়ে তার সম্পদ ও আসবাবপত্র ক্ষতিয়ে দেখা হোক। এসব দেখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কারণ বাবুল একজন সৎ ও নির্লোভ পুলিশ অফিসার। তাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে এখন নির্মম ষড়যন্ত্রের শিকার।
যুগান্তর : তাহলে মামলার ভবিষ্যৎ কি?
মোশাররফ হোসেন : আমি শুধু বলব, মামলাটি সঠিকভাবে তদন্ত করা হোক। নিরপেক্ষ তদন্তে যদি বাবুলের জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে আসে তবে আমরাই তার বিরুদ্ধে মামলা করব। সাক্ষ্য দেব। তার ফাঁসি চাইব। কারণ, এখন যেসব গল্প তৈরি করা হচ্ছে সেগুলো সত্য হতেও পারে আবার নাও পারে। কিন্তু মিতু যে খুনের শিকার হয়েছে তা একটি নির্মম বাস্তবতা।-সুত্র: যুগান্তর
২৯জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ