বুধবার, ০৬ জুলাই, ২০১৬, ১০:৩২:৫২

‘আমরা অনেক ভালো আছি, পত্রিকায় এটাই লিখে দাও’

‘আমরা অনেক ভালো আছি, পত্রিকায় এটাই লিখে দাও’

রশিদ আল রুহানী: রবিবার দুপুর ১টা। বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রবীণ হিতৈষী ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের চার তলায় উঠতেই দেখা গেলো তিন বৃদ্ধা গল্প-আড্ডায় মেতে রয়েছেন। কাছে যেতেই এক বৃদ্ধা জানতে চাইলেন, কি চাই? পরিচয় দিতেই ক্ষোভের সঙ্গে একটানা বলতে শুরু করলেন- আমাদের এখানে কেন এসেছ? আমরা চিড়িয়াখানার প্রাণী তাই দেখতে এসেছ? শুধু জেনে রাখো আমরা ভালো আছি, অনেক ভালো আছি। আর কোনও কথা জানতে চাইবে না।
কথাগুলো বলার পরে এক পর্যায়ে পাশের সিটে বসতে বললেন অন্য এক বৃদ্ধা জয়তুন্নেছা (ছদ্মনাম)। তিনি বলতে শুরু করলেন, এখানে আমাদের কোনও কষ্ট হচ্ছে না। আমরা অনেক ভালো আছি, এটাই পত্রিকায় লিখে দাও। উনার কথাগুলো শুনে বোঝা গেলো তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। অতি কষ্টে, মনের দুঃখে তিনি এসব বলছেন।
এই প্রতিষ্ঠান আপনাদের কেমন রেখেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে আমাদের আদরের অভাব নেই। তিন বেলা রান্না করে দেয়, পেট ভরে খাই। এখানে যারা আছি সবাই আমরা একে অপরের বন্ধু। তাদের সঙ্গে আড্ডা দেই, গল্প করি। এছাড়া সমসাময়িক খবর নিয়ে আলোচনা করি।
বললাম, কদিন পরেই তো ঈদ, বাড়ি যাবেন না? তিনি উত্তরে বললেন, আমার এক সন্তান। সে খুব ব্যস্ত। তাই আমি এখানে থাকি। তবে আজ সে আসবে আমাকে নিতে। তাছাড়া আমি তো মাঝে মাঝেই ছেলের কাছে যাই। গেলে ওরা খুশি হয়। কিন্তু আমিই যেতে চাই না। এখানকার ঈদ কেমন লাগে আপনার?  উত্তরে বলেন, এখানে সবাই আমরা একসঙ্গে থাকি। অনেক মজা লাগে, আনন্দ পাই।
পাশে থাকা অন্য এক বৃদ্ধা রোকসানা (ছদ্মনাম) বলেন, দেশে প্রবীণ নিবাসের সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত। আমরা এখানে মাত্র ৫০ জন থাকি। কিন্তু কতজনই তো আসেন সিটের খোঁজে, কর্তৃপক্ষ দিতে পারে না। কারণ আমরা বুক করে রেখেছি। প্রবীণদের থাকার জায়গা আরও কিভাবে বাড়ানো যায় সেটা নিয়ে সরকারের এবং মহৎ সমাজসেবকদের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন তিনি।কথার এক পর্যায়ে তারা সবাই স্থান ত্যাগ করেন। দূরে দেখা গেলো কয়েকজন নারীকর্মী রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কথা হলো একজন নারী কর্মীর সঙ্গে। তিনি বলেন, এখানে যারা থাকেন তারা সবাই ধনী পরিবার থেকে এসেছেন। এখানে থাকতে চার হাজার টাকা রুম ভাড়া আর ২ হাজার ২০০ টাকা খাওয়ার জন্য লাগে।
তাদের এক এক জনের জীবনে এক এক রকমের গল্প আছে। সন্তানদেরকে কষ্ট দিতে চান না বলে কেউ কেউ এখানে চলে এসেছেন, আবার কারও সন্তানরাই বাবা-মাকে এখানে রেখে গেছেন।

তিনি বলেন, অনেকেই আছেন যাদের বছরের পর বছর চলে যায় কিন্তু কেউ আসেন না। কোনও আত্নীয় স্বজন আসেন না। খুব কমই আছে এমন যে, তাদের আত্নীয়-স্বজন নিয়মিত আসেন।

এসব কথা বলতে বলতে কয়েকজন স্বজনকে বৃদ্ধাশ্রমে প্রবেশ করতে দেখা গেলো। এরা কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরা তো মৌসুমী স্বজন। ঈদ আসলেই কেবল এদেরকে বেশি বেশি দেখা যায়। তবে অনেকেই আছেন যারা মাঝে মাঝে ছুটির দিনগুলোতে আসেন। কেউ কেউ রান্না করে নিয়ে আসেন।

ওই নারীকর্মীর সঙ্গে কথা শেষ করতে না করতেই বৃদ্ধা জয়তুন্নেছা পাশে এসে বলেন, আসো তোমাকে আমার সন্তানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। পরিচিত হতেই তার ছেলে, ছেলের বউ  এবং এক নাতীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর জানতে পারলাম জয়তুন্নেছার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তিনি বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ইঞ্জিনিয়ার। অফিসে থাকি সারাদিন। তাই মাকে সময় দিতে পারি না। তাই মাও থাকতে চান না বাড়িতে। এখানে মায়ের কলেজ জীবনের এক বান্ধবী থাকেন মা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেই এখানে চলে এসেছেন। আমরা সময় পেলেই মাঝে মাঝে মাকে দেখতে আসি।
ঈদের দিন মাকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাকে নিতেই তো এসেছি কিন্তু মা যেতে চাইছেন না।
সন্তানের কাছে যেতে চাচ্ছেন না কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখানে যারা আছেন তাদের অনেককেই তাদের সন্তানরা নিতে আসবেন না। তারা একা থাকবেন। আমি ওদেরকে ছেড়ে যেতে চাই না। আমি ওদের সঙ্গেই থাকবো, ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করবো। ওদেরকে নিয়ে দিন পার করবো। এটাই আমার সুখ।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই দাদীকে দেখতে আসলেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উর্মি (ছদ্মনাম)। কথা বলতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ঈদের ছুটিতে দাদীকে দেখতে এসেছি। ক্লাস-পরীক্ষা থাকে, তাই ইচ্ছে হলেই আসতে পারি না। আজ আমি আসলাম, ঈদের দিন বাবা-মা আর ছোট ভাই আসবে।
তিনি বলেন, বাবা-মা ছাড়া তো বাসায় আর কেউ নেই। অনেক সময় আমার একা থাকতে ইচ্ছে করে না, দাদী থাকলে ভালোই লাগতো। কিন্তু তিনিও বাড়িতে থাকতে চান না, বাবা-মাও এসব নিয়ে কোনও কথা বলেন না।
বের হয়ে আসার সময় প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক বদরুল আহসান বলেন, বৃদ্ধাশ্রমে যারা থাকেন তারা তো ইচ্ছা করে আসেন না। তারা যতই বলুক ভালো আছেন, এটা তারা মিথ্যা বলেন। কারণ এই বৃদ্ধ বয়সে তারা সন্তানদের কাছেই থাকতে চান। কিন্তু কোনও না কোনও কারণে বাধ্য হয়ে তাদেরকে এখানে আসতে হয়েছে।-বাংলা ট্রিবিউন
৬ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে