নেহাল হাসনাইন: নামাজ পড়লেও পোশাক আশাকে অতোটা রক্ষণশীল ছিলেন না রেজওয়ানা রোকন নাদিয়া(২২)। কিন্তু নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই হঠাৎ করেই বদলে যান এই তরুণী। পাশাপাশি ছোটবোন রামিতাকেও (১৫) উৎসাহিত করেন হিজাব পরতে। ধীরে ধীরে বদলে যান বাবা ডা. রোকন উদ্দিন (৫৫) ও মা নাঈমা বেগমও (৩৮)।
সপরিবারে নিখোঁজ হওয়া চিকিৎসক রোকন উদ্দিনের পরিবারের খোঁজ নিতে গিয়ে এমন তথ্যই মিলেছে। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির নাম ঘুরে ফিরে আসছে। কারণ এই দুই হামলায় জড়িত অন্যতম দুই তরুণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান ছাত্র। এছাড়া গুলশান হামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হাসনাত করিম এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক শিক্ষক।
রাজধানীর খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার মাটির মসজিদের পাশে ৪৪১/বি নম্বর বাড়ি থেকে ২০১৫ সালের জুনে ঢাকা শিশু হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চাকরি ছেড়ে সপরিবারে দেশ ত্যাগ করেন ডা. রোকন উদ্দিন। যাওয়ার সময় তারা বলে যান, ‘মালোয়েশিয়া যাচ্ছি। এদেশ আর ভালো লাগে না। ওখানে গিয়ে দেখি, যদি কোনো মুসলিম দেশ ভালো লাগে তাহলে সেখানেই থেকে যাবো।’
ওই বাড়িতে কেয়ারটেকার হিসেবে প্রায় ৮ বছর ধরে চাকরি করছেন হেলাল উদ্দিন। তিনিই এই তথ্য দেন। হেলাল জানান, নাদিয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই হঠাৎ করে বদলে যান। নিয়মিত নামাজ পড়া এবং হিজাব পরে বাইরে বের হওয়া শুরু করেন। ছোটবোন ও মাকেও হিজাব পরতে উৎসাহিত করতো। এক সময় পুরো পরিবারই ধর্ম কর্মে খুব মনোযোগী হয়ে ওঠে।
এদিকে নাদিয়ার বড় খালা হালিমা বেগম যিনি ওই বাড়িতেই থাকেন এবং প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক বাবা আলী আহম্মেদের উত্তরাধিকারী হিসেবে হোমিওপ্যাথ চেম্বারে নিয়মিত বসেন, তিনি বলেন, ‘নাদিয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর সেখানে সাদ কায়েস শিশিরের (২৮) সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক হয়। এরপর থেকেই নাদিয়ার আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।’
‘নাদিয়া-শিশিরের সম্পর্কের কথা জেনে, তাদের বিয়েতে সম্মত হোন বাবা রোকন উদ্দিন ও মা নাঈমা বেগম। বিয়ের পর নাদিয়া ও শিশির এই বাড়িতেই থাকতে শুরু করে। এরপরই বদলে যায় রোকন উদ্দিন ও নাঈমা বেগম। তাদের আচরণেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন।’
‘সম্ভবত শিশিরের সীদ্ধান্তেই পুরো পরিবার নিয়ে দেশ ত্যাগের সীদ্ধান্ত নেয় নাঈমা ও রোকন। তবে গত রোজায় নাঈমা আমার কাছে ফোন করেছিল। খুব নিচু গলায় শুধু এইটুকই বললো যে, আমরা তুরস্কে আছি। ভালো আছি। এরপর আর কারো সাথেই যোগাযোগ করেনি তারা’, বলেন নাঈমা আক্তারের বোন হালিমা বেগম।
এদিকে নাঈমা সর্বশেষ সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যশোর সরকারি এমএম কলেজে শিক্ষকতা করছিলেন। ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই ফ্রাস, জার্মানি ও মালয়েশিয়া যাবেন বলে ৪৬ দিনের ছুটি নেন। ছুটি শেষেও কর্মক্ষেত্রে আর যোগ দেননি বলে কলেজ সূত্রে জানা যায়।
গত ১ জুলাই গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত যে পাঁচ তরুণ অভিযানে নিহত হয় তারা সবাই বেশ কিছু দিন ধরে নিখোঁজ ছিল। এরপর সারা দেশে আরো অনেক তরুণ নিখোঁজ থাকার তথ্য প্রকাশ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে ১০ জনের ছবিসহ বিস্তারিত পরিচয় গণমাধ্যমে আসে।
এই ঘটনার পরপরই ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর পুলিশ এবং সরকারের পক্ষ থেকে ‘নিখোঁজ’ সন্তানদের বিষয়ে বারবার তথ্য চাওয়া হচ্ছে। পুলিশও এ ব্যাপারে বেশ গুরুত্ব নিয়ে কাজ শুরু করে। নিখোঁজদের অনুসন্ধান করতে গিয়েই খিলগাঁওয়ের ওই পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। সন্ধান পাওয়া গেছে আরো দুই যুবকের।
এদের একজন ঢাকার গুলশানের সেজাদ রউফ ওরফে অর্ক ওরফে মরক্কো (পাসপোর্ট নম্বর: ৪৭৬১৪৫৯৯২) এবং অন্যজন বনানীর তাওসীফ হোসেন (পাসপোর্ট নম্বর: বিই ০৩৫২৭৬১ ডব্লিউ ০৫৫৯২২৭)।
একই পরিবারের ৫ জন নিখোঁজের ঘটনায় ইতিমধ্যে রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে পুলিশ। তথ্যটি নিশ্চিত করে রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জিডি হয়েছে। এখন তাদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। প্রাথমিকভাবে আগে আমরা নিখোঁজদের অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা করছি।’
উল্লেখ্য, ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসানে হামলায় জড়িত জঙ্গিদের মধ্যে নর্থ সাউথের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতার পর ব্যাপক সমালোচনার চাপে পড়ে দেশের স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ। এর মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে শোলাকিয়ায় ঈদগাহে বোমা হামলায় নিহত আরেক জঙ্গিরও পরিচয়ে মেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়টির সংশ্লিষ্টতা। জঙ্গিদের ‘আশ্রয়’ দেয়ার অভিযোগে রিমান্ডে আছেন খোদ প্রোভিসি। এরই মধ্যে ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী দম্পতি সপরিবারেই নিখোঁজের সন্ধান মিললো।-বাংলামেইল
১৯ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ