ইন্দ্রজিৎ সরকার ও আতাউর রহমান: ১ জুলাই রাত ৮টা ৪১ মিনিট। গুলশান-২ নম্বর সেকশনের ৭৯ নম্বর রোডের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় ধীরস্থিরভাবে হেঁটে প্রবেশ করছে দুই তরুণ। ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আরও তিনজন একইভাবে রেস্তোরাঁটিতে ঢোকে। তাদের সবার কাঁধে ব্যাগ। ঢুকেই এলোপাতাড়ি গুলি। গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের আশপাশের সড়কের সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণে এভাবেই পাঁচ জঙ্গির দৃশ্যপট উঠে আসে।
ফুটেজে দেখা যায়, জঙ্গিরা ভেতরে ঢুকে গুলি শুরুর পরপরই সন্দেহভাজন এক ব্যক্তি হলি আর্টিসানের ভেতর থেকে একটি গাড়ি নিয়ে সটকে পড়েন। হামলার আগে ওই ব্যক্তিকে রেস্তোরাঁর বাইরের সড়কেও রহস্যজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।
এদিকে, গতকাল জঙ্গি হামলায় জড়িত সন্দেহে এক তরুণীসহ চারজনের ভিডিও প্রকাশ করেছে র্যাব। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরা থেকে সংগ্রহ করা ভিডিওটি এদিন র্যাবের অনলাইন মিডিয়া সেলের ফেসবুক পাতায় প্রকাশ করা হয়। এই চারজনের ব্যাপারে সবার কাছে তথ্য জানতে চেয়েছে র্যাব। গতকাল বিকেলে ঢাকা মহানগর পুলিশ তাদের অনলাইন পোর্টালেও সন্দেহভাজন চারজনের ভিডিও আপলোড করে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, সিসি ক্যামেরার ছবি দেখে চার সন্দেহভাজনকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনায় তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হয়েছে। এ জন্য সবার কাছে তথ্য-সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
র্যাবের সরবরাহ করা ভিডিওটিতে দেখা যায়, ঘটনার রাতে এক ব্যক্তি একটি রূপালি রঙের মাইক্রোবাসের চালকের পাশের আসন থেকে নামছেন। এরপর তিনি দৌড়ে রাস্তা পার হন। মাইক্রোবাসটি তাকে নামিয়ে দিয়েই চলে যায়। কালো পোশাক পরা দ্বিতীয় ব্যক্তি ফুটপাত ধরে হেঁটে আসেন এবং প্রথমজনের সঙ্গে মিলিত হন।
তৃতীয় আরেক ব্যক্তিকে একইভাবে ফুটপাত ধরে হেঁটে আসতে দেখা যায়। সন্দেহভাজন দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যক্তিকে কিছু সময় ফুটপাতের কাছাকাছি অবস্থান করতেও দেখা যায়। সন্দেহভাজন চতুর্থজন এক তরুণী। তার পরনে সালোয়ার-কামিজ ও কাঁধে ব্যাগ ছিল।
র্যাবের ফেসবুক পাতায় গুলশান হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন চারজনের পরিচয় জানা থাকলে দ্রুত র?্যাবের যে কোনো ব্যাটালিয়ন বা ক্যাম্প অথবা ০১৭৭৭৭২০০৫০ নম্বরে ফোন করে অবহিত করতে বলা হয়েছে। এর আগে সোমবার বগুড়ায় জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযান শেষে র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ঘোষণা দেন, জঙ্গি দল ছেড়ে কেউ উগ্রপন্থিদের ব্যাপারে তথ্য দিলে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
র্যাবের কর্মকর্তারা জানান, তরুণীসহ সন্দেহভাজন চারজন সেই রাতের হামলায় জঙ্গিদের সহায়তা করেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা একাধিকবার ওই পথে হাঁটাহাঁটি করেছেন। কখনও তারা একে অন্যের সঙ্গে কথাও বলেছেন। সন্দেহভাজন দু'জনকে মোবাইলে কথা বলতে দেখা গেছে। তাদের শনাক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা গেলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি।
এমনকি হামলা শুরুর খবর পেয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হলি আর্টিসানের আশপাশের সড়কে পৌছার পরপরই সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তিরা এলাকা ত্যাগ করেন। পাঁচ জঙ্গিসহ সন্দেহভাজনরা কোন সড়ক হয়ে কীভাবে ৭৯ নম্বর রোডে প্রবেশ করেছিল তাও জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সিসি ক্যামেরা থেকে নেওয়া ভিডিওটি গত ১ জুলাই রাত ৮টা ৪২ থেকে ৯টা পর্যন্ত সময়ের। ওই সময়ের মধ্যেই গুলশান-২ নম্বর সেকশনের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় ঢুকে জঙ্গিরা সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। পরে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করা হয়। অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণে দুই পুলিশ কর্মকর্তা মারা যান। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সমন্বিত অভিযানে ছয় জঙ্গি নিহত হয় বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
র্যাবের সরবরাহ করা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সন্দেহভাহজন চারজনের বয়স আনুমানিক ২৫ থেকে ৩৫ বছর। তাদের মধ্যে তিন যুবকের পরনে ছিল ফুলপ্যান্ট ও হাফহাতা শার্ট। সন্দেহভাজন প্রথমজন সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। তৃতীয়জনকে মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেখা যায়। তাদের হাঁটাহাঁটির সময় রাস্তায় কয়েকটি রিকশা ও একটি দৃশ্যে গাড়ি থেমে থাকতে দেখা যায়। ভিডিওতে পাঞ্জাবি পরা টাকমাথার এক ব্যক্তিকে দু'বার দেখা গেছে, যাকে সন্দেহজভাজন হিসেবে শনাক্ত করেনি র্যাব।
মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা জানান, সিসিটিভির ফুটেজে দৃশ্যমান যে দুই জঙ্গি প্রথমে আর্টিসানে ঢুকেছিল তারা হলো নিবরাস ইসলাম ও রোহান ইবনে ইমতিয়াজ। পরে তিনজন একসঙ্গে রেস্তোরাঁয় ঢুকেছিল তারা হলো মীর সামিহ মুবাশীর, সফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুজ্জামান।
এ ছাড়া জঙ্গিরা রেস্তোরাঁয় হামলার পরপরই আর্টিসানের ভেতর থেকে একটি 'টয়োটা ফিল্ডার' ব্র্র্যান্ডের একটি গাড়ি রহস্যজনকভাবে এলাকা ত্যাগ করে। মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, গুলশানে হামলার অর্থ, প্রশিক্ষক ও মদদদাতাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে সন্দেহভাজন কয়েকজনের নামও পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রাজীব গান্ধী ওরফে শান্ত অন্যতম।
এ ছাড়া গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির এক শিক্ষককেও সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা জসীমুদ্দীন রাহমানীর সঙ্গে ওই শিক্ষকের ঘনিষ্ঠতা পাওয়া গেছে। এমনকি এ-সংক্রান্ত অর্থ লেনদেনের কিছু তথ্যও গোয়েন্দাদের কাছে রয়েছে। কয়েকজন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে ওই অধ্যাপক ইংরেজি কোর্সে ভর্তি করিয়েছেন।
'বড়ভাই' অবস্থান করছিল শেওড়াপাড়ার বাসায় :তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা জানান, গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলার পরিকল্পনাকারীদের এক 'বড়ভাই' শেওড়াপাড়ার বাসায় অবস্থান করছিলেন। জঙ্গিদের জন্য বিশেষ কালো পোশাক তৈরি করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া ওই বাসায় প্রায়ই জঙ্গিদের পরামর্শ সভা হতো। ধারণা করা হচ্ছে, জঙ্গিদের দলে বেশ কয়েকজন নারী সদস্য আছেন। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে কখনও কখনও তারা বাসা ভাড়া নেন।-সমকাল
২০ জুলাই, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ