তামান্না মোমিন খান: ২০০১ সালের ৪ঠা জুলাই বিকালে প্রতিদিনের মতো সজীব বাসা থেকে খেলতে বের হয়। যাবার সময় মাকে বলে গিয়েছিল সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। সজীব আর ফিরে না। মা অস্থির। রাস্তার সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। একদিন দুদিন করে ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও সজীবের জন্য এখনও অপেক্ষা করেন সজীবের মা। মোহাম্মদ রকিব উদ্দিন ও সেলিমা খাতুন দম্পতির সন্তান সজীব।
দুই ভাইয়ের মধ্যে সজীব ছিল বড়। সজীবের পুরো নাম জাবীর হাসান রাকীদ। তেজগাঁও বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। খুব ভালো ক্রিকেট খেলতো। গিটার বাজানো শিখেছিল শিশু একাডেমি থেকে। মায়ের সঙ্গে ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। সব গল্প করতো মায়ের সঙ্গে। একবার বিকেএসপিতে সাত দিনের ক্রিকেট ক্যাম্পে গিয়েছিল সজীব। সেখান থেকেও মাকে চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠি আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছে মা। সজীবের মা সেলিমা খাতুন আজও বিশ্বাস করেন সজীব বেঁচে আছে।
সেলিমা খাতুন বলেন, এখনও আশায় বুক বেঁধে আছি, একদিন না একদিন ফিরে আসবে ছেলে। সজীব এভাবে আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে না। সজীব যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিন সারা দিন বাসায় ছিল। অ্যালবামের ছবিগুলো কম্পিউটারে ঢুকিয়ে সবাইকে বলে এখানে ছবি রাখলে আর কোনো দিন নষ্ট হবে না। আসরের আজানের পর আমাকে বলে, আম্মা একটু নিচ থেকে খেলে আসি। সেদিন কেন যেন আমার বুকটা হু হু করে উঠেছিল।
আমি বললাম, দেরি করিসনে বাবা। বললো, সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো। রাত যত বাড়তে থাকে আমার অস্থিরতাও বাড়তে থাকে। বড় রাস্তায় গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি কিন্তু সজীব আর ফিরে না। এখনও বেঁচে আছি এই আশায়- সজীব ফিরে আসবে। আমার জানা মতে, সজীবের কোনো শত্রু ছিল না। খুব একটা বন্ধু-বান্ধবও ছিল না তার।
পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বিকালবেলা খেলতো। কখনও বাড়িতে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আসতো না। নামাজ পড়তো, রোজা রাখতো। ঠিকমতো পড়াশোনা করতো। সজীবের বাবা মোহম্মদ রকীব উদ্দিন চলচিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের অতিরিক্ত পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন।
রকীব উদ্দিন বলেন, ৪ঠা জুলাই সজীব নিখোঁজ হওয়ার পর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব পাড়া-প্রতিবেশী সবার বাড়িতে খোঁজ করেছি। কিন্তু সজীবকে পাওয়া যায়নি। এরপর ১০ই জুলাই তেজগাঁও থানায় জিডি করি। দেশের প্রথমসারির কয়েকটি সংবাদপত্রে সজীবের নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়। যখন যেখানে শুনেছি সজীবের বয়সী কোনো ছেলের সন্ধান পাওয়া গেছে সেখানেই ছুটে গেছি।
এমনকি থানা থেকে বেওয়ারিশ লাশের সংবাদ পেলেও ছুটে যেতাম। কিন্তু জীবিত বা মৃত কোনোভাবেই সজীবকে পেলাম না। কত মাজারে গিয়েছি, কত ফকিরের কাছে গিয়েছি, তবে আমরা হাল ছাড়িনি। আমার পুরো পরিবারের আমেরিকা যাওয়ার কাগজপত্র তৈরি হয়ে গেছে আট বছর আগে। কিন্তু আমরা যাইনি। কারণ সজীব যদি ফিরে আসে তাহলে তো আমাদের খুঁজে পাবে না।
আমি যত দিন বেঁচে আছি ৫৭, তেজকুনিপাড়া এই ঠিকানায় সজীবের জন্য অপেক্ষা করবো। জানি ১৫ বছরে অনেক বড় হয়ে গেছে সজীব। তাকে দেখলে হয়তো চিনতেও কষ্ট হবে। কিন্তু ওর বাবা-মা ঠিকই চিনে নেবে সজীবকে। সজীবের বাম পাশের চোখের ওপরে একটা কাটা দাগ আছে। সজীবের একমাত্র ছোট ভাই শাম্মু। সজীব যখন নিখোঁজ হয় তখন অনেক ছোট ছিল শাম্মু।
কিন্তু এখনও ভাইয়ার কথা মনে আছে তার। সজীবের ছবি দেখতে চাইলে শাম্মুই বের করে দেয় সজীবের ছবি। শাম্মু জানায়, ভাইয়া তাকে খুব আদর করতো। ভাইয়া চলে যাওয়ার পর থেকে অনেক একা লাগে তার। আম্মু তাকে আর খেলতে যেতে দেয় না। একা বেরও হতে দেয় না। সবসময় আব্বু না হয় আম্মু সঙ্গে থাকেন।-এমজমিন
২৬ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ