মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০১৬, ০৫:২৭:৪৯

এক যন্ত্রে সারে এক ডজন রোগ!

এক যন্ত্রে সারে এক ডজন রোগ!

শিশির মোড়ল: একটি মাত্র যন্ত্র দিয়ে এক ডজনের বেশি রোগ সারিয়ে তোলার দাবি করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও ওষুধ বিশেষজ্ঞরা এ রকম দাবিকে অবৈজ্ঞানিক ও ভাঁওতাবাজি বলে অভিমত দিলেও চিকিৎসা কাজে ওই যন্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকেও জানানো হয়নি। এখন সরকারি হাসপাতালেও এসব যন্ত্র ঢোকানোর চেষ্টা চলছে।


‘বায়ো-ইলেকট্রনিক হিলিং মেশিন’ নামের এ যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে বৈদ্যুতিক প্রবাহ দেওয়া হয়। এ যন্ত্র মাধ্যমে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোষ্ঠকাঠিন্য, সব ধরনের মাথাব্যথা, ঘাড়ব্যথা, পিঠব্যথা, অনিদ্রা, সব ধরনের বাতরোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করে। যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়মিত বিদ্যুৎপ্রবাহ নেওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেস, উদ্বেগ ও আতঙ্কগ্রস্ততা কমবে, ঘুম ভালো হবে, বিষণ্নতা দূর হবে, দেহের কোষ পুনরুজ্জীবিত হবে, অ্যালার্জি ভালো হবে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়বে, শারীরিক ক্লান্তি ও আঘাত থেকে দ্রুত পুনরুদ্ধার ঘটবে, রক্তের অম্লতা কমবে, সাইনাসের ব্যথা ও মাথাব্যথা দূর হবে।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে এই যন্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এই যন্ত্র দিয়ে মানুষকে প্রতারণা করা হচ্ছে।’


এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘যন্ত্রের অনুমোদন সম্পর্কে কিছু জানি না। আমি এই যন্ত্রের নাম শুনিনি।’

স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু: ইতিমধ্যে কেন্দ্র খুলে এই যন্ত্র দিয়ে চিকিৎসার নামে ব্যবসা শুরু হয়েছে। রাজধানীর উত্তর মুগদায় এ রকম একটি কেন্দ্রের নাম ‘জাপান-বাংলা হেলথ কেয়ার সেন্টার’। ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৯ ফুট প্রস্থের একটি কক্ষ। এক প্রান্তে খাঁচার মধ্যে ওভেনের মতো দুটো যন্ত্র রাখা। পাশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ যন্ত্র (ইউপিএস)। ছয়টি চেয়ার দুই সারিতে মুখোমুখি বসানো। চেয়ারগুলোর যন্ত্রের সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে সংযোগ দেওয়া। প্রতিটি চেয়ারের সামনে এক জোড়া করে রাবারের স্যান্ডেল।


১৮ জুলাই ওই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচ ব্যক্তি পাঁচটি চেয়ারে বসে বৈদ্যুতিক প্রবাহ নিচ্ছেন। প্রত্যেকের বাসা কেন্দ্রের আশপাশে। তাঁরা বললেন, উপকার পাচ্ছেন। একজন বললেন, হাঁটু ও ঘাড়ের ব্যথা কমাতে চার মাস ধরে চেয়ারে বসছেন। ব্যথা ভালো হয়নি। তবে কমেছে। অন্য একজন বলেছেন, যন্ত্র ব্যবহারের ফলে ডায়াবেটিস কমেছে কি না, তা মাপা হয়নি।
কেন্দ্র পরিচালনা করেন সেলিম খান। তিনি বলেন, ৩০ মিনিট বসার জন্য ৫০ টাকা দিতে হয়। অথবা মাসিক চুক্তিতেও চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মাসে এক হাজার টাকা। এই কেন্দ্রে বিনিয়োগ করেছেন একটি বেসরকারি বিমা কোম্পানির সাবেক কর্মকর্তা এ এইচ এম জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সঙ্গে আছেন তাঁরই একসময়ের সহকর্মী মো. শফিকুল ইসলাম।


কাগজপত্রে দেখা যায়, ‘বিডি জিন কোম্পানি লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠান জাপান থেকে যন্ত্র আনে। প্রবাসী দম্পতি আহমেদ জালালউদ্দিন ও সুলতানা রাজিয়া প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা। আর মো. শফিকুল ইসলাম সহযোগী উদ্যোক্তা।


মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রথমে একটি যন্ত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দিয়েছিলেন। আরও একটি যন্ত্র দিয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ের একজনকে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে ১৬টি যন্ত্র বিক্রি করেছেন। প্রতিটি যন্ত্রের দাম সাড়ে চার লাখ টাকা।


একটি সূত্র জানিয়েছে, পাঁচটি যন্ত্র সরকারি হাসপাতালে কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এগুলো কেনার জন্য এক কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও পরিচালক (হাসপাতাল) এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন।


দেশে বেসরকারি পর্যায়ে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এই কেন্দ্রের কোনো অনুমোদনও নেই। ক্ষমতাবহির্ভূত অনুমতি
সরকারের অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদনপত্রের ফটোকপি দেন।

তাতে বলা হয়েছে, ‘জাপানের তৈরি বায়ো-ইলেকট্রিক পটেনশিয়াল থেরাপি মেশিনটি বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসাসেবায় ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করা হইল।’


সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, ওষুধ বা চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেই। অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ বা যন্ত্রের অনুমোদন পাওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করতে হয়।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে, তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে ওষুধ বা যন্ত্রের অনুমোদন দেয় অধিদপ্তর। এ ক্ষেত্রে যন্ত্রের অনুমোদনের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে কোনো আবেদনই করা হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক মো. শামিউল ইসলামের কাছ থেকে এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, মহাপরিচালকের সম্মতিতে এ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।


জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন দিতে বাধা নেই। তিনি একটি যন্ত্র নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেছেন, কয়েক দিন ব্যবহারের পর তিনি যন্ত্রটি ফেরত দিয়েছেন।


বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। যেকোনো ওষুধ বা চিকিৎসাযন্ত্র ব্যবহারের আগে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। এর কার্যকারিতা যাচাই করা হয়। অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ওষুধ কোম্পানির নতুন ওষুধ বাজারজাত করার আগে একাধিক পরীক্ষার মাধ্যমে এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হয়। ঔষধ প্রশাসন সেই সব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজপত্র যাচাই করে অনুমতি দেয়। জাপানি এই যন্ত্রের মাধ্যমে এক ডজনের বেশি রোগ নিরাময় ও নিয়ন্ত্রণ হবে বলে দাবি করা হচ্ছে। এ দাবির সমর্থনে বৈজ্ঞানিক তথ্য থাকতে হবে।


তা ছাড়া পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টি যাচাই করাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বৈদ্যুতিক প্রবাহ নেওয়ার পর আদৌ কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে কি না, হলে কতটুকু, সে বিষয়েও বৈজ্ঞানিক তথ্য থাকতে হবে। সায়েদুর রহমান বলেন, ‘এই যন্ত্র ব্যবহারের ফলে কারও কোনো ক্ষতি হবে না এই নিশ্চয়তা দিতে হবে। অথবা ক্ষতি হলেও ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি সেই প্রমাণ থাকতে হবে।’ তবে কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই। ব্যবসায়ীরাও বৈজ্ঞানিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি।-প্রথম আলো

২৬ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে