রুদ্র মিজান: রাত তখন প্রায় ১২টা। রাস্তায় পুলিশ আর পুলিশ। জনসাধারণের চলাচল বন্ধ। দু-একটি গাড়ি ওই সড়ক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। রুম থেকে বের হয়ে বাড়ির গেইট বন্ধ করতে গিয়ে এই দৃশ্য দেখতে পান আবদুল মান্নান। মিরপুরের কল্যাণপুরের প্রধান সড়কের ২৯/সি বাড়িতে থাকেন তিনি। তার বাসার কাছেই ঘটনাস্থল জাহাজ বাড়ি।
কৌতূহল নিয়ে আশেপাশে তাকান আবদুল মান্নান। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাধা দেন পুলিশ সদস্যরা। ভেতরে চলে যেতে বলেন। অজানা আশঙ্কায় ছিলেন। রাত একটার দিকে গুলির শব্দ শুনতে পান তিনি। তারপর থেমে থেমে গুলি হচ্ছিলো। রাতে আর ঘুম হয়নি মান্নানের। গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পরিবারের সবাই জেগে ছিলেন সারারাত।
আবদুল মান্নানের ভাষায়, গুলির শব্দ বেড়ে যায় শেষ রাতে। রাত ৫টার দিকে মনে হচ্ছিলো যুদ্ধ হচ্ছে। ভয়ে শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। কিন্তু বের হওয়ার সাহস পাইনি। বুঝতে পারছিলাম গুলশানের মতো কিছু একটা হতে পারে।
একই কথা বলেন ঘটনাস্থল কল্যাণপুরের পাঁচ নম্বর সড়কের ৫৩ নম্বর তাজ মঞ্জিলের পাশের বাড়ির বাসিন্দা শিউলি আক্তার ইশা। শিউলি জানান, রাত ১টায় শব্দ শুনে ভয়ে পরিবারের সবাই এক রুমে জড়ো হন। শব্দটা বেশ কাছে হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছিলো। বুঝতে চেষ্টা করেন কিসের শব্দ। ইশা ও তার বাবা দরজা খুলে বাইরে তাকানোর চেষ্টা করেন। মুহূর্তের মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা সতর্ক করে দেন- দরজা বন্ধ করে ভেতরে থাকেন। বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করবেন না।
ইশা জানান, রাত ১টা থেকে ৫টা পর্যন্ত গুলির শব্দ ছিল থেমে থেমে। ভোরে জোরে জোরে শব্দ হচ্ছিলো। পাঁচ নম্বর সড়কের মোড়ের দীন কেজি অ্যান্ড দীন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রহরী আশরাফুল ইসলাম জানান, ভোর ৫টার দিকেই বোমা-গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে। এসময় পুলিশ তাকে ডেকে তোলে। তখন পুরো মহল্লাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শত শত সদস্য।
আশরাফুল বলেন, পুলিশ তাকে সাহস দিয়ে বলেছেন ভয়ের কিছু নেই। অভিযান চলছে। অভিযান চলছিলো তাজ মঞ্জিলের পঞ্চম তলায়। সেখানে থাকতো জঙ্গিরা। জাহাজের মতো আকৃতির জন্য স্থানীয়দের কাছে জাহাজ বিল্ডিং নামে পরিচিত এই বাড়ি। পুরনো ছয় তলা এই বাড়ির তৃতীয় তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত মেস। প্রতিটি তলায় রয়েছে দুটি ইউনিট।
প্রতি ইউনিটে চারটি করে কক্ষ। বাড়ির পঞ্চম তলায় ‘অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্স’ পরিচালনার সময় ভেতরে আটক ছিলেন অনেকে। অভিযানের শ্বাসরুদ্ধকর সময় অতিবাহিত করেছেন তারা। বাড়ির ষষ্ঠ তলায় থাকতেন আবু সায়েম। অভিযানের পর শ্যামলীর পলিটেকনিকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র সায়েমের সঙ্গে কথা হয় তার ভাই মতিউর রহমানের।
সায়েমের বরাত দিয়ে মতিউর রহমান জানান, রাত সাড়ে ১২টার পরে বাসার পাশে পুলিশের উপস্থিতি টের পান তারা। মনে হচ্ছিলো এই ভবনেই কোথাও অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। রাত ১টার দিকে একটা গুলির শব্দ পান। ওই সময়ে মুহুর্মুহু গুলির শব্দে তারা সবাই রান্নাঘরে আশ্রয় নেন। বাড়িতে ফোনে দোয়া চেয়েছেন।
সায়েম বলেছেন, দেড়টায় এতো গুলির শব্দ হচ্ছিলো যে, মনে হচ্ছিলো আমাদের দরজায় গুলি করা হচ্ছে। আমরা বোধ হয় বাঁচবো না। ষষ্ঠ তলার বাসিন্দা আল্লামা ইকবাল অনিক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে কাজ করতেন। ইকবালের সঙ্গে কথা হয় তার এক সহকর্মীর। ইকবাল জানান, রাত ১টার দিকে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পান তিনি। একটু পর পর গুলির শব্দে মনে হচ্ছিলো কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে। ভোরের দিকে গুলির শব্দ বেড়ে যায়।
ইকবাল জানান, তখন মনে হচ্ছিলো তিনি আর বাঁচবেন না। ফোনে অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েছেন। বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন তিনি। ষষ্ঠ তলায় একসঙ্গে সায়েম, অনিক, শাহাবুল, কামরুলসহ সাত জন থাকতেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ তাদের নিয়ে গেছে বলে জানান সায়েমের ভাই মতিউর রহমান।-এমজমিন
২৭ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ