সরোয়ার আলম ও রেজোয়ান বিশ্বাস: “গভীর রাত। আমরা সবাই লেখাপড়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মুহুর্মুহু গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। পাঁচতলার মেস থেকে গুলির আওয়াজ ও বহুকণ্ঠে চিৎকার শুনি ‘আমরা তোদের ছাড়ব না। নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার। তোদের সঙ্গে পরকালে দেখা হবে।’
এরপর আমরা কেউ রান্নাঘরে পালিয়েছি; কেউ বা তোশক-চাদর, কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছি। গুলির শব্দ ক্রমেই বাড়তে থাকে। তখন মনে হচ্ছিল আমাদের জিম্মি করা হচ্ছে।” এভাবেই ভীতিকর অবস্থার কথা বর্ণনা করেন জঙ্গি আস্তানা কল্যাণপুরের ৫৩ নম্বর বাড়ির ষষ্ঠ তলার বাসিন্দা আবু সায়েম আশিক।
আশিকের মতো ওই মেসে থাকা অন্যদের সঙ্গে কথা হলে তাঁরাও একই রকম বলেন। ওই ভবনের ছয়তলার মেসে আশিকসহ ৯ জন শিক্ষার্থী থাকেন। তাঁদের মধ্যে সাতজন সোমবার রাতে মেসে ছিলেন।
শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের ছাত্র আশিক বলেন, ‘রাত পৌনে ১টার দিকে হঠাৎ পরপর তিনটি গুলির শব্দ পাই। ঘুম ভেঙে যায় আমার। পাশের রুমে গিয়ে কামরুল, অনিক, শাহাবুলসহ অন্যদের ডেকে ওঠাই। জানালা খুলে দেখতে পাই বাইরে শত শত পুলিশ। প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র।
আমাদের বাড়ির দিকে তাক করে আছে। এর মধ্যে বিকট শব্দ পাই পাঁচতলা থেকে। সবাই ভয়ে লুকিয়ে যাই ও দোয়া-দরুদ পড়তে থাকি। মনে হচ্ছিল এই বুঝি জীবনের শেষ রাত। সবাই পরিবারের লোকজনকে ফোন দিতে থাকি। এভাবে সারা রাত নির্ঘুম কেটেছে আমাদের।’
আশিকের রুমমেট ইকবাল অনিক একটি অনলাইন পত্রিকায় কাজ করেছেন। ঢাকার ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করছেন। অনিক বলেন, ‘সারাটা রাত রান্নাঘরে লুকিয়ে ছিলাম। একটু পরপর গুলির শব্দ হচ্ছিল। খুব ভয় হচ্ছিল।
তখন মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল মা-বাবার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসে বুঝি লাশ হয়ে ফিরব। সকাল হওয়ার পর অভিযান শেষ হলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। তবে পুলিশ আমাকেসহ সাতজনকে আটকে রেখেছে। বলছে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় যেতে হবে।’
গত রাতে কল্যাণপুর ৫ নম্বর রোডের ওই বাড়িতে পুলিশ ও জঙ্গিদের গোলাগুলির সময় অন্যান্য বাড়ির বাসিন্দাদেরও নির্ঘুম রাত কেটেছে। ওই বাড়ির পাশের ভবনের বাসিন্দা মো. জাকির বলেন, রাত ১২টার পর হঠাৎ গুলির শব্দে তাঁর ঘুম ভাঙে। গুলির শব্দ বাড়তে থাকলে তিনি জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরে অনেক পুলিশ দেখতে পান।
এরপর সারা রাত বাথরুমে লুকিয়ে থাকেন তিনি। জাকির বলেন, ‘রাতে পুলিশ ও জঙ্গিদের মধ্যে কয়েক শ রাউন্ড গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ভোরের দিকে গুলির ঘটনা বাড়তে থাকে। অভিযান শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি ও আমার পরিবারের লোকজন কেউ খাটের নিচে, কেউ বা বাথরুমে লুকিয়ে সারা রাত দোয়া-দরুদ পড়েছি।’
জাকিরসহ আরো অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই বাড়িতে যে জঙ্গি ঘাঁটি ছিল তা আগে কারো জানা ছিল না। বাড়িটির প্রধান ফটক সব সময় বন্ধ থাকত। পাঁচতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত মেসে ব্যাচেলররা থাকত। তবে বাড়িতে কিছু যুবকের সন্দেহজনক গতিবিধি নিয়ে এলাকায় কানাঘুষা ছিল।
৫ নম্বর রোডের আরেক বাড়ির বাসিন্দা আব্দুল্লাহ বলেন, জঙ্গি ঘাঁটিতে অভিযানের সময় ব্যাপক গোলাগুলির মধ্যে পরিবার নিয়ে বিপদে ছিলেন তাঁরা। আগে কখনো তাঁরা এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েননি।
স্থানীয়রা জানায়, কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের গার্লস হাই স্কুলের পাশে ৫৩ নম্বর বাড়ির গায়ে ‘তাজ মঞ্জিল’ নাম লেখা থাকলেও স্থানীয়রা ছয়তলা ওই ভবনকে চেনে ‘জাহাজ বিল্ডিং’ নামে। বাড়িওয়ালার পরিবার থাকে দ্বিতীয় তলায়। প্রতিটি তলায় রয়েছে চারটি করে ফ্ল্যাট। ওপরের কয়েকটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে ব্যাচেলররা মেস করে থাকে।
স্থানীয় আরো অনেক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কল্যাণপুর এলাকায় অনেক মাদ্রাসাও রয়েছে। ওই সব মাদ্রাসার অনেক ছাত্র মেসেও থাকে। কিন্তু এর আগে জঙ্গি কার্যক্রমের কথা তাঁরা শোনেননি। গত রাতের মতো অভিযান এখানেএটাই প্রথম।-কালের কন্ঠ
২৭ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ