দিনাজপুর : চার মেয়ের জন্মের পর হতদ্ররিদ্র আব্দুস সামাদের ঘরে এক ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। ১৯৮৭ সালে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের মিরাটঙ্গী গ্রামে ওবায়দুলের জন্ম।
শত কষ্টের মধ্যেও একমাত্র ছেলের সব চাহিদা পূরণ করতেন মৌসুমী ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদ। ওবায়দুলের বয়স যখন ৬ বছর তখন বাড়ির পাশে চকদফর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান তার বাবা-মা।
মায়ের স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে ছেলে বড় চাকরি করবে। কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মা চন্দনী বেগম।
মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা পাঁচ সন্তানের জনক আব্দুস সামাদ দিশাহারা হয়ে আত্মীয়দের অনুরোধে স্বামী পরিত্যক্ত এক নারীকে বিয়ে করেন।
এরই মধ্যে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ওবায়দুলকে ঠাকুরগাঁও ম্যাজিক কার্ট টেইলার্সে কাজ শেখার জন্য নিয়ে যান তার বাবা। অভাবের সংসারের কথা শুনে শিশু ওবায়দুলকে কাজের সুযোগ দেন টেইলার্স মালিক গৌরাঙ্গ।
সেখানে ৬ বছর কাজ করার পর কয়েক দর্জি শ্রমিকের সহযোগিতায় ভালো বেতন ও সুযোগ সুবিধা পাওয়ার আশায় ঢাকায় চলে আসে ওবায়দুল।
পাঁচ বছর আগে ওবায়দুলের বাবা আব্দুস সামাদ পাইকারও মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর ওবায়দুল ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসলেও বেশিদিন থাকতো না। পার্শ্ববর্তী গ্রামে তার বড় বোনের বাড়িতে দু-চারদিন থাকার পর আবার ঢাকায় চলে যেত।
ওবায়দুলের এক বাল্যবন্ধু জানান, বাবার মৃত্যুর পর গ্রামে আসতো ওবায়দুল। প্রতিটি ঈদ গ্রামে এসে করতো। তাকে সর্বশেষ সোমবার দুপুরে লাটের হাট বাজারে দেখা গেছে।
‘কিন্তু তখনো জানা ছিল না যে, সে হত্যাকাণ্ডের মতো একটি জঘন্য কাজ করেছে। বিষয়টি জানান পর হতবাক হয়ে যাই। এমনিতে ওবায়দুল কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এলাকায় কোনো মেয়েকে উত্ত্যক্ত করেছে এমন কথাও শুনিনি কখনো।
গত সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় রমনা থানার এসআই মো. মোশারফ হোসেন বীরগঞ্জ থানা পুলিশের সহযোগিতায় ঘাতক ওবায়দুলের নিজ বাড়ি মিরাটঙ্গী গ্রামে অভিযান চালায়। অভিযানের আগেই বাড়িতে তালা দিয়ে পালিয়ে যায় পরিবারের অন্য সদস্যরা।
পরে ৩১ আগস্ট বুধবার সকালে সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পথে নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার সোনারাই বাজারে নাস্তা খাওয়ার সময় মাংস বিক্রেতা দুলালের সহযোগিতায় ওবায়দুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
মোহনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মজিদুল ইসলাম মাস্টার জানান, এ ছেলে একটি মেয়েকে শুধু হত্যা করেনি সবাইকে কলঙ্কিত করেছে।
গ্রেফতার হওয়ার পর দুর্ধর্ষ ও জঘন্য এই অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে আসছেন স্কুলের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। আজ আদালতে বাদীর আইনজীবীরা সেই দাবিই জানিয়েছেন।
ওবায়দুলের অপরাধকে জঘন্য ও ন্যক্কারজনক বলে উল্লেখ করেছেন আইনজীবীরা। এ ধরনের অপরাধ আর একটাও দেখতে চায় না দেশবাসী। এসময় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো রিশার মা খুনি ওবায়দুলকে সামনাসামনি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। দাবি করেন সর্বোচ্চ শাস্তি।
প্রধান আইনজীবী মো. আব্দুল্লাহ আবু শুনানিকালে আদালতকে বলেন, রিশা হত্যার ঘটনা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে নাড়া দিয়েছে। যে নৃশংসতায় তাকে হত্যা করা হয়েছে তা আর যেন না ঘটে, সে জন্য ওবায়দুলের মতো আসামির সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করতে হবে।
গত ২৪ আগস্ট বৈশাখী টেইলার্সের কাটিং মাস্টার ওবায়দুল খান উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে ছুরি দিয়ে জখম করার পর থেকে পলাতক ছিল।
রোববার ২৮ আগস্ট আইসিইউতে রিশা মারা গেলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা আন্দোলন শুরু করেন। এ সময় তারা ওবায়দুলকে গ্রেফতারে আলটিমেটাম দেন।
এরপর বুধবার নীলফামারি থেকে তাকে আটক করে রাতেই ঢাকা আনা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে ওবায়দুলকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত শুনানি শেষে ৬দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আদালতে যখন খুনি ওবায়দুলকে হাজির করা হয়, তখন মামলার বাদী রিশার মা ও বাবা উপস্থিত ছিলেন। শুনানিকালে রিশার মাকে বাদীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কোনোভাবেই তার কান্না বাধা মানছিল না। ওবায়দুলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়ে হারানোর কষ্ট যেন আরো দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এমআর/এসএম