শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১১:৫৬:৫৩

এই প্রথম রত্ন, মণি, মাণিক্যের মেঘে ঢাকা ভিন গ্রহের হদিশ মিলল

এই প্রথম রত্ন, মণি, মাণিক্যের মেঘে ঢাকা ভিন গ্রহের হদিশ মিলল

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : দুর্মূল্য, দুর্লভ রত্ন, মণি, মাণিক্য ভেসে বেডাচ্ছে আকাশে! রাশি রাশি মেঘ হয়ে! ভেসে বেডাচ্ছে চুনি, পান্না, নীলকান্ত মণি রশি রাশি, ঘন মেঘ হয়ে! উত্তরোত্তর জমে জমে সেই মেঘ ঘন, আরও ঘন হচ্ছে। আরও বড জায়গায় জুেড ছডিয়ে পডছে সেই মেঘ। ভেসে বেডাচ্ছে আকাশ জুেড। একটি ভিন গ্রহে।

এই প্রথম আমাদের সৌরমণ্ডল থেকে অনেক অনেক দূরে এমন একটি রত্ন, মণি, মাণিক্য, নীলকান্ত মণিতে ভরা ঘন, পুরু মেঘে ঢাকা একটি ভিন গ্রহের হদিশ পেলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। আমাদের সৌরমণ্ডল থেকে ১,০৪০ আলোকবর্ষ দূরে। কেপলার স্পেস টেলিস্কোপের নজরে এই প্রথম ধরা পডল সেই ভিন গ্রহটি। যার নাম- 'এইচএটি (হ্যাট)-পি-সেভেন বি'। ব্রিটেনের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদেরই প্রথম নজরে পেডছে এই বিস্ময়কর ভিন গ্রহটি।

গত সোমবার তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল 'নেচার-অ্যাস্ট্রোনমি'তে। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- 'ভেরিয়াবিলিটি ইন দ্য অ্যাটমস্ফিয়ার অফ দ্য হট জায়েন্ট প্ল্যানেট 'এইচএটি (হ্যাট)-পি-সেভেন বি'। মূল গবেষক ব্রিটেনের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর েডভিড জে আর্মস্ট্রং। তাঁর সহযোগী গবেষকদের অন্যতম আমেরিকার আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, অনাবাসী ভারতীয় বিষ্ণু রেড্ডি।

সেই ভিন গ্রহ-'এইচএটি (হ্যাট)-পি-সেভেন বি' কী ভাবে হদিশ মিলল এই দুর্লভ, দুর্মূল্য রত্ন, মণি, মাণিক্যের ঘন মেঘে ঢাকা আমাদের সৌরমণ্ডলের অনেক অনেক দূরে থাকা এই ভিন গ্রহটির?

আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে আরিজোনা থেকে বিষ্ণু ই-মেলে লিখেছেন, ''এই ভিন গ্রহটি সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পাঠিয়েছিল নাসার কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রচুর তথ্য ও ছবি পাঠিয়েছিল ওই ভিন গ্রহের আকাশে ভেসে বেডানো মেঘেরও। সেই সব তথ্যের ভিত্তিতেই আমরা ওই ভিন গ্রহটির বায়ুমণ্ডল, সম্ভাব্য আবহাওয়া নিয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে রীতিমতো অবাক হয়ে যাই। দেখি, আমাদের বৃহস্পতি গ্রহটির চেয়েও চেহারায় ৪০ গুণ বড আর আমাদের পৃথিবীর চেয়ে কম করে ৫০০ গুণ ভারী ওই ভিন গ্রহটির আকাশে রাশি রাশি ঘন মেঘ ভেসে বেডাচ্ছে। ভিন গ্রহটি তার 'সূর্য'কে পাক মারছে খুব কাছ থেকে। পৃথিবী সূর্যের যতটা কাছে রয়েছে, এই ভিন গ্রহটি তার অন্তত ৩০০ গুণ বেশি কাছে রয়েছে তার 'সূর্যে'র।

মূল গবেষণাপত্রটি মিলবে নীচের ঠিকানায় :
এতটাই কাছে যে, সেই 'সূর্য'কে পাক মারতে ভিন গ্রহটির সময় লাগে মাত্র ২.২ দিন (যেখানে আমাদের সূর্যকে পাক মারতে পৃথিবী সময় নেয় মোটামুটি ৩৬৫ দিন)। ফলে, সেই 'সূর্যে'র (নক্ষত্র) গনগনে তাপে ওই ভিন গ্রহটির পিঠ একেবারে ঝলসে যাচ্ছে। আরও ভাল ভাবে বলতে হলে, ভিন গ্রহটি জ্বলে-পুেড খাক হয়ে যাচ্ছে। আমাদের উপগ্রহ চাঁদের একটা পিঠ যেমন সব সময় থাকে পৃথিবীর দিকে (যেটাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, 'টাইড্যালি লক্ড'), তার 'সূর্যে'র দিকে তেমনই সব সময় 'বুক পেতে রাখে' ওই ভিন গ্রহটির একটি দিক (পিঠ বা সারফেস)। আর সেই ভিন গ্রহটি যাকে পাক মারছে, সেই 'সূর্য'টি আমাদের সূর্যের

চেহারার অন্তত দু'গুণ। অত বড সূর্য, তার অত কাছে সেই গ্রহ আর সেই গ্রহের একটা পিঠ সব সময় প্রখর সূর্যের তাপ বুক পেতে নিচ্ছে। মানে, ভিন গ্রহটির ওই পিঠে সব সময় দিন। দিবালোক। তাই আমরা ভেবেছিলাম, ওই ভিন গ্রহের আকাশে কখনও মেঘ জমতে পারে না। আমরা ভেবেছিলাম, ভিন গ্রহটির যে পিঠটি কোনও সময়ই সূর্যের আলো পায় না, তুলনায় অনেক অনেক ঠাণ্ডা হওয়ায়, একমাত্র সেই দিকেরই আকাশে মেঘের দেখা পাওয়া যাবে। আর ভিন গ্রহের যে-দিকটি সব সময় 'বুক পেতে রেখেছে' সূর্যের দিকে, সেখানকার আকাশে মেঘ জমার ফুরসত্‍ই পাবে না। সূর্যের গনগনে তাপ তা ফুত্‍কারে উডিয়ে দেবে।''

কী ভাবে পরিবর্তন ঘটছে ভিন গ্রহের বায়ুমণ্ডলে কিন্তু বিস্ময়কর কী দেখতে পেয়েছিলেন গবেষকরা?

তাঁদের গবেষণাপত্রে মূল গবেষক ব্রিটেনের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর েডভিড জে আর্মস্ট্রং লিখেছেন, ''আমরা দেখেছি, ভিন গ্রহটির দুই পিঠের আকাশেই মেঘ জমছে। আর সেখানকার বায়ুমণ্ডল অসম্ভব রকমের বিক্ষুব্ধ। আবহাওয়াও প্রচণ্ড পাগলাটে। কোনও ভিন গ্রহের গবেষণায় বায়ুমণ্ডলের এমন আচরণ এর আগে লক্ষ্য করা যায়নি। কোনও ভিন গ্রহের বায়ুমণ্ডলের এমন আচার-আচরণ সে অর্থে, ঐতিহাসিক। অত্যন্ত দুর্লভ, দুর্মূল্য রত্ন, মণি, মাণিক্যে ভরা মেঘ হলে তার যেমন আচার-আচরণ আশা করা যায়, ওই ভিন গ্রহের দুই পিঠের আকাশে আমরা যে মেঘের সম্ভাবনা দেখেছি, তারও আচরণ ঠিক তেমনটাই।''

সেই ভিন গ্রহ-'এইচএটি (হ্যাট)-পি-সেভেন বি' কিন্তু কী ভাবে গবেষকরা নিশ্চিত হলেন, ওই ভিন গ্রহের দুই পিঠের আকাশেই ভেসে বেডাচ্ছে রাশি রাশি ঘন, পুরু মেঘ?

কী ভাবে পরিবর্তন গ্রহের বায়ুমণ্ডলে
আরিজোনা থেকে পাঠানো ই-মেলে বিষ্ণুর জবাব, ''ভিন গ্রহটির পিঠে আমরা একটি উজ্জ্বলতম জায়গা (ব্রাইটেস্ট স্পট) লক্ষ্য করেছি। দেখেছি, সেই উজ্জ্বলতম জায়গাটি সরে সরে যাচ্ছে এখান থেকে ওখানে। যে ভাবে আকাশে মেঘ ভেসে বেডায়। এটা দেখেই আমরা অনুমান করেছি, ওখানে আদতে ওটা একটা মেঘ। আর সেই মেঘগুলিকে আমরা ভিন গ্রহটির যে পিঠটি কখনওই সূর্যের আলো পায় না, সেই দিক থেকে গ্রহটির সেই পিঠ, যেটা সূর্যের দিকে 'সব সময় বুক পেতে রেখেছে', সেই দিকে সরে সরে যাচ্ছে। সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে বইছে হাওয়া। যাকে তুমুল ঝডও বলা যায়। আর তার গতিবেগ অত্যন্ত নাটকীয় ভাবে দ্রুত, খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ফলে, এক সময় প্রচুর মেঘ জমছে আর তার কিছু ক্ষণ পরেই সেই মেঘ ভিন গ্রহটির ঝলসে যাওয়া পিঠটির আকাশে গিয়ে প্রচণ্ড তাপে উবে যাচ্ছে। উধাও হয়ে যাচ্ছে। আমরা গবেষণায় নিশ্চিত হয়েছি, ভিন গ্রহটির যে পিঠটি সব সময় তার সূর্যের দিকে 'বুক পেতে রেখেছে', তার তাপমাত্রা অন্তত ২ হাজার ৮৬০ ডিগ্রি কেলভিন বা ৪ হাজার ৬৮৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট।''

ভিন গ্রহের বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তনের সেই গ্রাফ কিন্তু সেই মেঘ যে জলীয় বাস্প থেকে তৈরি বা জমা হচ্ছে না, সে ব্যাপারে কী ভাবে নিশ্চিত হলেন গবেষকরা?

তাঁর ই-মেল জবাবে আরিজোনা থেকে অধ্যাপক বিষ্ণু রেড্ডি লিখছেন, ''অত প্রচণ্ড তাপমাত্রায় জলীয় বাস্পের মেঘ কোনও দিনই তৈরি হতে পারে না। তা জমাও হতে পারে না। একমাত্র একটি খনিজ পদার্থই ওই প্রচণ্ড তাপমাত্রায় টিঁকে থাকতে পারে। তার নাম- 'কোরান্ডাম'। যা কেলাস আকারে থাকলে, আমরা বলি- চুনি বা নীলকান্ত মণি। তবে ২০১৮ সালে আরও শক্তিশালী 'জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ' মহাকাশে কাজ শুরু করে দিলে এই ভিন গ্রহটি আর তার বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে আরও নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। আমাদের অনুমান একশো শতাংশ সঠিক কি না, তা-ও যাচাই করে নেওয়া যাবে।''

ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: অধ্যাপক বিষ্ণু রেড্ডি, আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়। -আনন্দবাজার।
১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে