বৃহস্পতিবার, ০৪ মে, ২০১৭, ০১:০১:৫২

‘পোয়াতি কি নিজের ইচ্ছায় হইছি’

‘পোয়াতি কি নিজের ইচ্ছায় হইছি’

তামান্না মোমিন খান : খুপরি ঘর। টিনের বেড়ার ভাঙা অংশ চট দিয়ে ঢাকা। তেজগাঁও রেল বস্তির এ ঘরেই দশ সন্তান নিয়ে বসবাস পেয়ারা বেগমের। বিয়ের প্রথম বছরেই কোল জুড়ে আসে সন্তান। আদরের ধনকে লালন পালন করছিলেন যত্ন করে। কিন্তু সন্তানের দু’মাস যেতে না যেতেই আবার গর্ভে আসে দ্বিতীয় সন্তান।

বলেন পোয়াতি কি নিজের ইচ্ছায় হইছি কন? জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা বলতেই পেয়ারা বেগম বলেন, হুনছি। কিন্তু কোনো দিন কেউ আমার কাছে আহে নাই। কোথায় বড়ি পাওয়া যায় হেইডাও জানি না। স্বামীরে এক দুইবার কইছি, পাত্তা দেয় নাই।

পেয়ারা জানান, বিয়ের পর স্বামী বাহার আলীর হাত ধরে কুমিল্লা থেকে তেজগাঁও রেলওয়ে বস্তিতে এসে উঠেন। বিশ বছর আগের কথা। প্রথম সন্তানের জন্ম এখানেই। এরপর এক-এক করে দশ সন্তান জন্ম দেয় পেয়ারা।

পেয়ারা বলেন, তের বছরে আমার দশ সন্তানের জন্ম। পেয়ারা বেগমের ছোট ছেলের বয়স সাত বছর। এই সাত বছর ধরে কোনো সন্তান তার জন্ম নেয়নি। বলেন, এমনি এমনি সন্তান হওয়া বন্ধ হইয়া গেছে। পেয়ারা বেগম বলেন, আমার এক মেয়ে আর আমি ক’দিন আগে পরে সন্তান জন্ম দিছি। একের পর এক সন্তান জন্ম দেয়ায় পেয়ারার শরীর জীর্ণশীর্ণ। পেয়ারার বয়স এখন চল্লিশ বছর। দেখলে মনে হয় বুড়িয়ে গেছেন।

তিনি বলেন, ছোট ছেলের বয়স সাত বছর। তার বড় নাতি আর ছোট ছেলের বয়স এক সমান। বড় ছেলের বয়স ১৯ বছর। সন্তানদের লেখাপড়াও শেখাতে পারেননি অভাবের কারণে। বলেন, ওরাও বাবার সঙ্গে কাওরান বাজারে মিনতির কাজ করে। লেখাপড়া করাতে টাকা লাগে। এক মেয়ে গার্মেন্টে কাজ করে।

কাওরান বাজারে অবস্থিত পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বহুতল ভবন থেকে উঁকি দিলেই চোখে পড়ে তেজগাঁও রেলওয়ে বস্তি। সেখানে প্রায় হাজারখানেক পরিবারের বসবাস। কেউই পরিবার পরিকল্পনার সেবা পাননি। সরজমিন বস্তি ঘুরে জানা গেছে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোনো পদ্ধতিই তারা গ্রহণ করে না। এতে করে প্রতিটি পরিবারেই পাঁচ থেকে দশ জন পর্যন্ত সন্তান রয়েছে।

এ বস্তিরই আরেক গৃহবধূ কমলা বলেন- তিনিও বিশ বছর ধরে এ বস্তিতে বসবাস করেন। বলেন, কখনও কোনো পরিবার পরিকল্পনার  কর্মীদের এ বস্তিতে আসতে দেখিনি। কিছু দিন ধরে মাসে দুইবার দুই- তিন জন কর্মী আসে এই বস্তিতে। কিন্তু তারা দশ মিনিটের বেশি থাকে না। এই বস্তিতে হাজার হাজার মানুষ বাস করে। তারা খবরই পায় না মাঠকর্মীরা কখন আসেন আর কখন যান।

একই বস্তিতেই ১৩ বছর ধরে থাকেন ফরিদা। বাড়ি নেত্রকোনায়। তার স্বামী কাওরান বাজারে মিনতির কাজ করেন। ফরিদা পাঁচ সন্তানের জননী। কখনো কোনো পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়নি তার। জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোনো সেবা নিতেও কখনো কোনো ক্লিনিকে যাননি ফরিদা। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কেন গ্রহণ করেননি?

ফরিদা বলেন, অভাবের সংসার। স্বামী দিনমজুর। পেটের খাবার জোগাড় করতেই সময় পার হয়ে যায়। এছাড়া কোথায় বড়ি পাওয়া যায় সেইটাই তো জানি না। আর টাকা দিয়া বড়ি কেনার সাধ্যতো আমাদের নাই। আমি সারা দিন বাসাবাড়িতে কাজ করি। স্বামী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাওরান বাজারে মিনতির কাজ করে। বস্তিতে কখন পরিবার-পরিকল্পনার কর্মীরা আসে সেইটাও বলতে পারবো না।

একই বস্তিতে থাকেন রানু বেগম। তারা স্বামী-স্ত্রী দুইজনই কাওরান বাজারে তরকারি বিক্রি করেন। রানুর সন্তান ছয়টি। রানু বলেন, আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় আমার ছয় বাচ্চা হইছে। আল্লাহ চাইলে আরো হইবো। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন না কেন? জানতে চাইলে রানু বলেন- বড়ি খাইলে কোনো অসুখ-বিসুখ হয় কিনা এই ভয়ে বড়ি খাই না। বড়ি ছাড়াও তো আরো অনেক পদ্ধতি রয়েছে সেগুলো কখনো নিয়েছেন।

রানু বলেন, আমরা গরিব মানুষ এত কিছু জানি না। কেউ এইসব বিষয়ে আমাদেরকে জানায় নাই। পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মীদের সঙ্গেও এসব বিষয়ে কখনো আলাপ হয়নি বলে জানান রানু। বস্তির আরেক গৃহবধূ রাশেদা বলেন, সারাদিন ব্যস্ত থাকি সংসারের খাবার জোগাড়ে। পোলাপানরে লালন পালন করা, রান্নাবান্না এসব করতে করতে রাইত অইয়া যায়। রাশেদার বিয়ে হয়েছে ১০ বছর। বিয়ের ১১ মাস পর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়।

রাশেদা বলেন, এর এক বছর না পেরুতেই আবার আরেক সন্তান। একজন কোলে থাকতেই আরেকজনের জন্ম। দুই জনরে এক সঙ্গে বুকের দুধ খাওয়াইছি। এরপর একে একে আরো চার সন্তান। খুব কষ্ট করে সংসার আর সন্তানকে আগলে রাখছি। স্বামী কাজ থেকে আইলে তারে আগে খাওন দেওন লাগে। সব মিলাইয়া সুখ কি জিনিস দেখলাম না। সন্তান কম হলে ভালো হতো না? ভালোতো হতোই। তবে আমি কি ইচ্ছা কইরা সন্তান জন্ম দিছি কন? কেন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেননি?

রাশেদা বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণের কথা হুনছি। স্বামীরেও কইছি। স্বামীও কইছে বড়ি আইনা দেব। কিন্তু এভাবেই দিন পার হইয়া গেছে। তেজগাঁও রেলওয়ে বস্তিতে প্রবেশ করতেই দেখা যায় প্রতি ঘরের সামনে একাধিক শিশুর চেঁচামেচি। কেউ খেলা করছে। কেউবা কান্না করছে। শিশুর মেলা যেন এই বস্তিতে। গৃহবধূদের কোলে, হাতে শিশু। জন্মনিয়ন্ত্রণের সুফল পৌঁছাতে সরকারের বার্তা নিয়ে কেউ গিয়েছে কিনা জানেন না অনেকেই। ফলে গৃহবধূদের ধারণা বিয়ে মানেই সংসার। আর সংসার মানেই সন্তান জন্ম দেয়া। এমজমিন
৪ মে, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে