এক্সক্লুসিভ ডেস্ক: আজ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ব্যবহৃত হওয়া বর্ষপঞ্জি ‘ইংলিশ ক্যালেন্ডার ইয়ার’ নামে পরিচিত হলেও আসলে এই ক্যালেন্ডার রোমানদের তৈরি। তারা আবার এটি ধার করেছিল গ্রিকদের কাছ থেকে । প্রাচীন গ্রিকবাসীদের নিজস্ব বছরের সময়কাল ছিল তিনশো চার দিনের এবং তা দশটি মাসে বিভক্ত । বছরের সূচনা ধরা হতো মার্চ মাস থেকে । খ্রিস্টপূর্ব সাতশো অব্দে রোম-সম্রাট নুমা পম্পিলিউস গ্রিক ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বছরের এগারো ও বারো মাস হিসাবে যথাক্রমে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি-কে যুক্ত করেন । ওই বারো মাসের ক্যালেন্ডারটি আগের থেকে ভাল হলেও তাতে কিছু সমস্যা থেকে যাচ্ছিল। তবু দীর্ঘ দিন ওই ব্যবস্থাই বজায় ছিল। অনেক দিন পর খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রোম-সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নির্দেশে ক্যালেন্ডারকে তারিখ অনুযায়ী সাজানো হলো এবং জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি হল বছরের প্রথম এবং দ্বিতীয় মাস ।
সিজারের সময়কালে নির্মিত এই ক্যালেন্ডারকে ‘জুলিয়েন ক্যালেন্ডার’-ও বলা হয়ে থাকে ।ইংরেজি ক্যালেন্ডার ইয়ারের প্রথম মাস জানুয়ারি । এই মাসটিকে নববর্ষের প্রবেশ-তোরণ । ‘জানুয়ারি’ এই নামটিে সেছে প্রাচীন দু-মাথাওয়ালা রোমান দেবতা ‘জানুস’ (anus) থেকে। পুরাণে তিনি দ্বাররক্ষক বা প্রবেশ পথের দেবতা । প্রসঙ্গত বলা যায়, বৈশাখ মাসে বাংলা নববর্ষের সূচনায় বাঙালিরা যে দেবতার পুজো করে, সেই গণেশও ঘটনাচক্রে দ্বার রক্ষণের দেবতা হিসাবে চিহ্নিত।
রোমান পুরাণে বলা হয়েছে, জানুস একটি মাথা দিয়ে অতীতের দিকে দৃষ্টি রাখেন, আর তার অন্য মাথার দৃষ্টি ভবিষ্যতের দিকে প্রসারিত । বছরের দ্বিতীয় মাস ‘ফেব্রুয়ারি’-র শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ‘ফেব্রুয়ারিয়াস’ (februarius) থেকে, যার অর্থ শুদ্ধ করা । রোম-সম্রাট পম্পিলিউস প্রবর্তিত প্রাচীন রোমান ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারি বছরের শেষ মাস হিসাবে চিহ্নিত ছিল। এই শেষ মাসে রোমানরা একটি শুদ্ধিকরণ বা পুরনো বছরের যা কিছু খারাপ যত আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে নতুন বছরকে আমন্ত্রণ করবার উৎসব করত; অনেকটা বাংলা বছরের চৈত্রশেষের গাজন উৎসবের মতো । এই শুদ্ধিকরণ উৎসবের নাম থেকেই মাসটির নাম ‘ফেব্রুয়ারি’। প্রথম দিকে ফেব্রুয়ারি মাসের দিন সংখ্যা ছিল তিরিশ ।
জুলিয়াস সিজার তার থেকে একটি দিন কেটে নিয়ে বছরের মাঝের দিকের একটি মাস ‘কুইন্টিলিস’ (quintilies)-এর সঙ্গে যুক্ত করেন (পরে ওই মাসটিকে সিজারের নামানুসারে ‘জুলাই’ নামে চিহ্নিত করা হয়)। আবার আর এক রোম-সম্রাট অগস্টাস ফেব্রুয়ারি থেকে আরও একটি দিন কেটে নিয়ে ‘সেক্সটিলিয়েস’ (sextilies) নামের মাসটির সঙ্গে জুড়ে দেন সেই মাসটিও পরে সম্রাটের নামানুসারে ‘অগস্ট’ নামে চিহ্নিত হয়)। ফলে ফেব্রুয়ারি মাসের দিন সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় আঠাশ।
এদিকে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে যখন জানা গেল যে, পৃথিবীর বার্ষিক গতির সময়কাল ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ২৪ মিনিট, তখন পুরো বছরকে ৩৬৫ দিনের হিসাবে মাস অনুযায়ী ভাগ করে নিলেও সমস্যা হল অতিরিক্ত ৬ ঘণ্টা সময়কে নিয়ে। তখন হিসেবপত্র করে স্থির করা হল যে, ওই ৬ ঘণ্টাগুলিকে যোগ করে প্রতি চার বছর অন্তর একটি করে দিন বেশি ধরা হবে। এই অতিরিক্ত দিনটি যে বছর যোগ করা হবে তার নাম হবে ‘লিপ-ইয়ার’। দুই রোমান সম্রাট কর্তৃক দিন কেটে নেওয়ার ফলে ফেব্রুয়ারি মাসের দিন সংখ্যা কমে হয়েছিল আঠাশ । তাই অতিরিক্ত দিনটি যোগ করে দেওয়া হল ফেব্রুয়ারি মাসের সঙ্গে। সেজন্য প্রতি চার বছর অন্তর ফেব্রুয়ারি মাসের দিন সংখ্যা হয় উনত্রিশ।
গণনার সুবিধার জন্য স্থির করা হয়, যে সমস্ত অব্দ বা বছর চার দ্বারা বিভাজ্য, সেই সব বছরকে ‘লিপ-ইয়ার’ ধরা হবে । আমাদের দেশে ঋতু পর্যায়ের বসন্তকালের মধ্য পর্বটি ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মার্চ মাস। অর্থাৎ ফাল্গুনের শেষ আর চৈত্রের শুরু । বসন্তের এই সময়টা প্রকৃতির তাণ্ডবের কাল । বছর শেষের ধুলোময়লা ঝেড়ে ফেলতে আবির্ভাব হয় অকাল ঝড়-বৃষ্টির, বাংলায় যার নাম ‘কালবৈশাখী’। আগেই দেখেছি, প্রাচীন রোমক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরের প্রথম মাস ছিল মার্চ। প্রকৃতির এই রূদ্ররূপের ব্যঞ্জনাকে ধরে রাখতেই বছরের প্রথম মাসের নাম রাখা হয়েছিল ‘মার্চ’। শব্দটি এসেছে রোমান যুদ্ধ-দেবতা ‘মার্স’ (Marc)-এর নাম থেকে। যিনি ভয়ঙ্কর, লোমশ । আত্মরক্ষার জন্য বর্ম আর শিরস্ত্রাণ পরে হাতে ঢাল আর বল্লম নিয়ে সর্বোচ্চ যুদ্ধসাজে সজ্জিত। তবে রোমানদের পুরাণ অনুসারে মার্স শুধু যুদ্ধেরই দেবতা নন, তিনি শস্য ও উপাসনারও দেবতা । সেজন্য বোধহয় প্রাচীন রোমকরা তাদের বছরের প্রথম মাসটির নামকরণ করেছিল যুদ্ধের ও শস্যের দেবতার নামে। পরবর্তীকালে মাসটি বছরের তৃতীয় মাসে পরিবর্তিত হলেও নামটি কিন্তু সেই একই রয়ে গেছে ।
বছরের চতুর্থ মাস এপ্রিল-এর নামকরণ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। রোমানদের মতে এই মাসটি তাদের প্রেমের দেবী ‘ভেনাস’(Venus)-এর কাছে উৎসর্গীকৃত মাস । Venus শব্দটিকে গ্রিক ভাষায় বলা হয় ‘অ্যাফ্রেডাইটি’ (Aphrodite), যা থেকেই এপ্রিল (April) শব্দটির উৎপত্তি । এই নিয়ে কিছু অন্য মতও আছে, অনেকে মনে করেন ল্যাতিন (Perio) শব্দ থেকে এপ্রিল কথার উৎপত্তি, যার অর্থ উন্মুক্ত করা । প্রকৃতির তাণ্ডবের শেষে এপ্রিল মাস যেন বছরের প্রকৃত শুরুর মাস । বসন্ত-আরম্ভের প্রথম দিনের উৎসবকে স্মরণ রাখতে ১ এপ্রিলকে ‘সব বোকাদের দিন’ বা All Fools’ Day হিসাবে পালন করবার প্রথা প্রাচীন কাল থেকেই শুরু হয়েছিল।
বছরের প্রথম মাস ‘মে’-এর নামটি এসেছে গ্রিক পুরাণে বর্ণিত পৃথিবী ধারণকারী এ্যাটলাস-এর কন্যা মায়া (Maia)-র নাম থেকে। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে ১ মে তারিখটি একজন ‘মে-কুইন’ অভিষিক্ত করবার উৎসব হিসাবে পালন করা হত । ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে আমেরিকার শিকাগো শহরে সংঘটিত শ্রমিক আন্দোলনের স্মৃতি হিসাবে ১ মে দিনটি পৃথিবীব্যাপী শ্রমিক শ্রেণির ‘মুক্তি দিবস’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক ছুটির দিন ।
ষষ্ঠ মাস ‘জুন’-এর নামকরণের উৎস নিয়েও দ্বিমত রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ‘জুনিয়াস’ (Junius) নামে কোনও একটি রোমান পরিবারের নাম থেকে এর উৎপত্তি। কিন্তু অধিক প্রচলিত মত হল ‘জুন’ নামটি এসেছে গ্রিক দেবরাজ জুপিটারের রানি জুনো (Juno)-র নাম থেকে, যিনি ময়ূরবাহিত রথে চড়ে ঘোরাফেরা করতেন। প্রাচীন রোমে জুন মাসের প্রথমে দেবী জুনোর সম্মানে উৎসবের আয়োজন করা হতো ।
সপ্তম মাস ‘জুলাই’-এর নামটি এসেছে বিখ্যাত রোম-সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নাম থেকে। জুলিয়াস সিজার কর্তৃক ক্যালেন্ডার পুনর্গঠন করবার সময়য়ে জুলাই মাসের সময়কালের মাসটির নামকরণ নিয়ে সমস্যা দেখা দিল । প্রাচীন রোমক ক্যালেন্ডার অনুসারে এটি ছিল বছরের পঞ্চম মাস । তাই নামও ছিল Quintilis। কিন্তু নতুন ক্যালেন্ডারে এটিকে স্থাপন করা হল সপ্তম স্থানে। সেজন্য সিজার এর নাম পরিবর্তন করে নিজের নামানুসারে July রাখেন । আরেকটি মত হল সিজারের মৃত্যুর পর (খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দ) এই নামকরণ হয়।
এমটি নিউজ/এপি/ডিসি