ঢাকা : এমন হবে জানলে নামটা পাল্টে ফেলতাম। আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রে আমার সব গেল। না পারলাম বিয়ে করতে, না পারলাম বিয়ে দিতে। হারালাম সামাজিক মর্যাদা। জীবনটা এখন দুঃসহ মনে হয়। চার বছর দু’মাস ১৭ দিনের স্মৃতির কথা আমি ভুলতে পারি না। যারা আমার জীবন বাঁচালো সেই মিডিয়ার লোকদের এড়িয়ে চলি আমি।
আমি ও পরিবারের জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছি।
ভিটে মাটি সব হারালাম। অর্থ কষ্টে নিজে বিয়ে করতে পারিনি, একমাত্র বোনকে বিয়ে দিতে পারিনি। মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও সর্বদা হুমকি আর জীবননাশের ভয়ে পালিয়ে থাকি।
এভাবেই ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন খালেদা জিয়ার সরকারের সাজানো নাটকের বলি জালাল আহম্মদ ওরফে জজ মিয়া।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের এদিন ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলায় আটক হয় জজ মিয়া।
জজ মিয়ার বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কেশারপাড় ইউনিয়নের বীরকোর্ট গ্রামে। টেণ্ডল বাড়ির মৃৃত আবদুর রশিদ ও জোবেদা খাতুনের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় জজ মিয়া।
বড় দু’ভাই আলাদা থাকলেও ছোটভাই, বোন এবং বৃদ্ধা মাকে নিয়েই থাকেন তিনি। ছোটভাই বাবু ঢাকায় মাছের ব্যবসা করেন।
জজ মিয়া বলেন, মামলায় আমার সব গেছে। ছোট একটি চাকরি করতাম তাও ছেড়ে দিয়েছি। এখন মাছের আড়তে কাজ করি। আমার চিন্তায় মা মৃত্যু শয্যায়। ঘটনা ফাঁস করে দেয়ায় আমার পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। কি যে হবে ভেবে পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, কেউ খোঁজ নেয় না আমার। দিনটির কথা মনে পড়লে আঁতকে ওঠি আমি।
জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন বলেন, ‘ছেলের মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে সব হারালাম। জজ মিয়া একটি টেলিভিশনে চাকরি করলেও হুমকির কারণে ছেড়ে দিয়ে এখন মাছের ব্যবসা করে। মেয়েটাকেও (খুরশিদা বেগম) বিয়ে দিতে পারলাম না।
তিনি বলেন, ছেলেটার কিছু হলে ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। যারা জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছেন তাদের কঠোর বিচার দাবি করেন তিনি।
জোবেদা খাতুন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ করার কারণে আমার ছেলের এ অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী কি আমাদের দিকে আমাদেও দিকে নজর দেবেন। দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো। সরকার পরিবর্তন হলে এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিরাপত্তা চান তিনি।
সেনবাগ কেশারপাড় ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, জজ মিয়া নাটকে পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে গেল। বাপের ভিটা পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে। লজ্জায় জজ মিয়া এলাকায় আসে না।
জানা গেছে, জজ মিয়ার বাবা আবদুর রশিদ ১৩ বছর আগে মারা যান। তিনি ঢাকায় ফলের ব্যবসা করতেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সেনবাগের কানকিরহাটে টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার খবর দেখছিলেন জজ মিয়া। প্রায় সাড়ে ৯ মাস পর ২০০৫ সালের ৯ জুন সেনবাগের এক বিএনপি নেতার নির্দেশে সিআইডির হাতে গ্রেফতার হন তিনি।
সিআইডির নির্দেশে সেনবাগের বীরকোর্ট রাজা মিয়ার দোকান থেকে তাকে গ্রেফতার করেন তৎকালীন সেনবাগ থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) কবির হোসেন।
পরে সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয় তাকে। এর কয়েকদিন পর জজ মিয়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িত বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়। এ খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
জজ মিয়াসহ পরিবারের সব সদস্যকে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দেয়ার কথা জজ মিয়ার বোন খুরশিদা বেগম ভুলে সাংবাদিকদের কাছে বলে ফেলে। এরপর সারাদেশ কেঁপে ওঠে। ফাঁস হয়ে যায় সিআইডির কাছে দেয়া জোট সরকারের ‘জজ মিয়া’ নাটক। ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে থাকে।
২০০৮ সালের ১১জুন সিআইডি ২২ জনকে আসামি করে চার্জশিট দিলেও জজ মিয়াকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
বিস্ফোরক মামলায় জজ মিয়াকে ২০০৫ সালের ২ নভেম্বর ৭ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তদন্তের পর জজ মিয়া নাটকের ঘটনা উন্মোচিত হয়।
গ্রেফতার করা হয় নাটকের মূলনায়ক সিআইডির তিন তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি আবদুর রশিদ, এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিনকে।
ওই তিনজনকে আসামি করে মামলা করা হয়। পাশাপাশি মামলায় যুক্ত করা হয় তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে। বর্তমানে ৪ জনই কারাগাওে আছেন। সিআইডির দেয়া চার্জশিট পুনরায় তদন্ত করা হয়। তদন্ত শেষে জজ মিয়াকে বাদ দেয়া হয়।
৪ বছর ২ মাস ১৭ দিন কারাবাসের পর ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান জজ মিয়া।
২১ আগস্ট-২০১৩/এমআর/এসএম/