এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : এমন বাড়িও তৈরি হচ্ছে যে বাড়ির কোনো ছাদই নেই। প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে সেখানে৷ ছাদ বিলাসের কথা উঠে এসেছে এই সময়ের এক প্রতিবেদনে। লিখছেন অনিরুদ্ধ ধর।
‘শিং নেই, তবু নাম তার সিংহ’৷ এ কথা গানে গানে কিশোরকুমার সেই কবে বলে গিয়েছেন! সেই কথা সত্যি হলো এতোদিনে৷ একবার ভেবে দেখুন, আস্ত একটা বাড়ি আছে, তার বসার ঘর, শোওয়ার ঘর, খাওয়ার জায়গা, রান্নাঘর- সব আছে৷ কিন্তু নেই শুধু ছাদ!
হ্যাঁ মশাই, সত্যিই তাই৷ একে 'ডিম নয়, তবু অশ্বডিম্ব' বলা ছাড়া উপায় কী? সেই সূত্র ধরেই একেও বলা হচ্ছে বাড়ি৷ সেই বাড়ি সম্পর্কে দু-চার কথা পরে জানাচ্ছি৷ তার আগে বাঙালির ছাদ-বিলাস নিয়ে কয়েকটি কথা৷
বাঙালির, বিশেষ করে বাঙালি-মহিলাদের কাছে ছাদের একটা আলাদা গুরুত্ব আগেও ছিল, এখনো আছে৷ ছাদ মানে খানিকক্ষণ একলা হয়ে থাকার একটা বিস্তৃত স্পেস৷ সারাদিন সংসার সামলে, পড়ন্ত বিকেলে নিজের মুখোমুখি হওয়ার জায়গাই হলো ছাদ৷
অনেক রাতে ঘুম ভেঙে তারা-ভরা আকাশের তলায় নিজেকে উন্মুক্ত করার একমাত্র জায়গা সেই ছাদই৷ এর বাইরে তিনি পুরনো একান্নবর্তী পরিবারের মহিলাই হোন কিংবা আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট নিবাসিনীই হোন, ছাদই হলো তার কাছে পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যা অথবা 'নেক্সট ডোর নেবার'-এর সঙ্গে মন খুলে মেয়েলি আড্ডা দেয়ার উত্কৃষ্ট 'কমিউনিটি সেন্টার'৷
ছাদ কীভাবে একা হয়ে থাকার স্পেস হিসেবে কাজ করে তেমন একটা উদ্ধৃতি দেয়া যাক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গোরা' উপন্যাস থেকে৷ 'এমন সময় ললিতা রাত্রির কাপড় পরিয়া ছাদে আসিল৷ সুচরিতাকে কিছুই না বলিয়া তাহার পাশ দিয়ে গিয়ে ছাদের রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইল৷'
'রেলিং' প্রসঙ্গ যখন চলেই এলো, তখন বলে রাখা ভালো বাঙালি জন্মাবধি দু-রকম ছাদের কথা শুনে এসেছে৷ এক, ন্যাড়া ছাদ, যাকে ইঞ্জিনিয়াররা বলেন, 'ফ্ল্যাট রুফ'৷ অর্থাত্ ছাদের কোনো আগল নেই৷ আছে শুধু কার্নিশ৷
পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে, ঠিক যেমন ভয় পেয়েছিলেন ন্যাড়া ছাদে দাঁড়িয়ে 'দুর্গেশনন্দিনী'র বিমলা৷ বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, 'প্রত্যুত্পন্নবুদ্ধিশালিনী বিমলা ক্ষণকালমাত্র বিহ্বলা ছিলেন, শস্ত্রধারীর দ্বিরুক্তিতে তাহার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলেন৷ বিমলার পশ্চাতেই ছাদের শেষ, সম্মুখে সশস্ত্র যোদ্ধা, ছাদ হইতে বিমলাকে ফেলিয়া দেওয়াও কঠিন নহে৷' অতএব, ন্যাড়া ছাদকে বেঁধে ফেলা হলো রেলিং দিয়ে৷ যাকে আধুনিক কারিগরি ভাষায় বলা হয় 'গার্ড ওয়াল' বা
'গার্ড রেলিং'৷ গোদা বাংলায় 'ছাদের পাঁচিল'৷ অথবা আলসে, বা আলিসা৷ এই পাঁচিল কখনও নিরেট, আবার কখনও তাতে ছোট-ছোট ফাঁক, যাকে বলে পাঁচিলের ঘুলঘুলি৷ রবীন্দ্রনাথের 'মানভঞ্জন'-এ এমনই এক পাঁচিলের ঘুলঘুলিতে চোখ রেখে দাঁড়ায় একা গিরিবালা৷
'রমানাথ শীলের ত্রিতল অট্টালিকায় সর্বোচ্চতলের ঘরে গোপীনাথ শীলের স্ত্রী গিরিবালা বাস করে৷ শয়ন কক্ষের দক্ষিণ দ্বারের সম্মুখে ফুলের টবে গুটিকতক বেলফুল এবং গোলাপফুলের গাছ৷ ছাদটি উচ্চপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা- বহিঃদৃশ্য দেখিবার জন্য প্রাচীরের সঙ্গে সঙ্গে একটি করিয়া ইট ফাঁক দেয়া আছে৷'
রবীন্দ্রনাথের এই লেখায় ছাদ-বাগানের একটা ছোট্ট ইঙ্গিত রয়েছে৷ এভারক্রিয়েটিভ বাঙালি মহিলাদের এক টুকরো স্পেস পেলেই ফুল ফোটানোর নেশায় মেতে ওঠা আজকের নয়, বহুদিনের৷ ইদানীং সে-সব ফুল বাহারি টবে ফ্ল্যাটবাড়ির ব্যালকনিতে শোভা পায়৷ অ্যাপর্টমেন্টে ছাদ থাকলেও সেই স্পেসটি তার একার নয় বলেই৷
এবারে আসা যাক 'ছাদহীন' বাড়ি প্রসঙ্গে৷ আগে-ভাগে বলে রাখি এ ধরনের বাড়ি করার প্রস্তাব কোনো বাঙালি গৃহকর্তা তার স্ত্রীকে দেয়ার আগে চারবার ভাববেন৷ কারণ এরই মধ্যে নিশ্চয়ই তিনি বুঝে গিয়েছেন বঙ্গনারীর কাছে ছাদের গুরুত্ব ঠিক কতটা৷
কিন্তু ছাদহীন বাড়ির মধ্যেও রোম্যান্টিক ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন অধুনা মার্কিন পপ গায়ক ফ্যারেল উইলিয়ামস৷ এ ভাবনাও উড়িয়ে দেয়ার নয়৷ তার সাম্প্রতিক মেগা-হিট গান 'হ্যাপি'তে তিনি ছাদহীন বাড়ির অনন্ত রোম্যান্টিকতা সম্পর্কে জানিয়েছেন, বিকজ আই অ্যাম হ্যাপি/ক্ল্যাপ অ্যালং ইফ ইউ ফিল লাইক আ রুম উইদাউট আ রুফ/বিকজ আই অ্যাম হ্যাপি/ক্ল্যাপ অ্যালং, ইফ ইউ ফিল লাইক হ্যাপিনেস ইজ দ্য ট্রুথ৷'
অর্থাত্ ছাদহীন বাড়ির মতো অনুভব যদি এসে পড়ে তাহলেই তুমি, আমি সুখী৷ ফ্যারেলের মতে, এই অনুভূতি আয়ত্ত করা সম্ভব৷ অবিশ্যি এই অনুভূতি ঠিক কেমন তা কেবল বলতে পারবেন ফিলাডেলফিয়ার 'স্কাই হাউস' আবাসনের বাসিন্দারা৷ 'স্কাই হাউস' সংস্থার ছা-হীন বাড়ি মানেই ধরে নেয়া অসম্ভব নয় আবাসনের প্রতিটি বাড়িই এক তলা৷ ছাদই নেই তো দোতলা হবে কেমন করে?
তারা যে আবাসন নির্মাণ করছেন, সেই আবাসন বিলাসবহুল এবং অর্থবানদের জন্য৷ এবং তাদের বিজ্ঞাপনের ক্যাচ-লাইন হোল, 'টোটালি প্রাইভেট'৷ এ বাড়ির বিশেষত্ব হলো ওপন এয়ার লিভিং রুম, ছাদহীন শোওয়ার ঘর এবং ডাইনিং স্পেস৷ বিছানায় শুয়ে-শুয়ে চোখে টেলিস্কোপ লাগিয়ে তারা দেখতে-দেখতে নিদ্রা যাওয়ার বন্দোবস্ত পাকা৷
মূলত গ্রীষ্মকালীন রিসর্ট বলা যেতে পারে এই 'নো-রুফ' স্ট্রাকচারকে৷ কারণ বর্ষায় এবং শীতে বৃষ্টি এবং তুষার বসবাস করার পক্ষে অন্তরায়৷ সেই সময়, অবিশ্যি অস্থায়ী আচ্ছাদন দিয়ে ঢাকা থাকে এই বাড়ি৷ বাড়ির দেয়াল এতোটাই উঁচু এবং এমনভাবে তৈরি যে অন্য কেউ বাড়ির বাসিন্দার প্রিভেসি-তে এতটুকু ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে৷
কিন্তু ভাবুন তো একবার, এই বাড়ির আলসে নেই, কার্নিশ নেই, পাঁচিল নেই, কাক-বসা আলসের রোম্যান্টিকতা নেই যে বাড়ির, সেই বাড়িতে কি থাকা সম্ভব? 'সেই সময় মেয়েটি ছাদে চিলেকোঠায় পা মেলে বই পড়ে, কোনোদিন বা বইয়ের ওপর কাগজ রেখে চিঠি লেখে, আধবাঁধা চুল কপালের উপরে থমকে থাকে, আর আঙুল যেন চলতে চলতে চিঠির কানে-কানে কথা কয়৷ একদিন বাধা পড়লো৷ সেদিন সে খানিকটা লিখেছে চিঠি, খানিকটা খেলছে কলম নিয়ে, আর আলসের ওপর একটা কাক আধ-খাওয়া আমের আঁটি ঠুকরে খাচ্ছে৷' (অস্পষ্ট: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
পৃথিবীর নানা কোণায় পরিবেশবিদরা আকুল হয়ে পড়ছেন, কতো লাখ বাড়ির ছাদ যে যথাযথ ব্যবহারের অভাবে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে, এই ভেবে৷ এমনই এক ভাবুক সংস্থা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকল্যান্ড শহরের 'বে লোকালাইজ'৷ তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ফেলেছেন সম্প্রতি কমিউনিটি ফাউন্ডেশন এবং লরেন্স লিভাইস চ্যারিটেবল ফান্ডের অর্থানুকূল্যে৷
তারা একটি গাউডবুক নির্মাণ করেছেন৷ লিখেছেন নয়, নির্মাণ করেছেন বলাই শ্রেয়৷ কারণ এটি বিজ্ঞান-সমাজতত্ত্ব-পরিবেশ৷ সব মিলিয়ে একটি গবেষণা পত্র৷ অবহেলিত, পড়ে থাকা অজস্র ছাদ-মালিকদের উদ্দেশ্যে নির্মিত এই গাইডবুকটির নাম, 'আ গাইডবুক অফ রিসোর্সেস অ্যান্ড কনসিডারেশন ফর রেনওয়াটার ক্যাচমেন্ট, রুফ গার্ডেনস অ্যান্ড শোলার পাওয়ার'৷
কীভাবে বাড়ির ছাদে বৃষ্টির জল জমিয়ে সবজি বাগান বানিয়ে এবং সোলার প্যানেল লাগিয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্য, বিদ্যুত্ এবং জলের বন্দোবস্ত করা যেতে পারে তারই নির্দেশনামা৷ অর্থাত্ বাড়ির ছাদ শুধু আপনার বাসস্থানের নিরাপত্তাই নয়, পাশাপাশি সেটি হয়ে উঠুক পরিবেশ বন্ধুও৷
১৯৫২ সাল৷ ফ্র্যান্সের মার্সেই শহরে এক নতুন ধরনের আবাসন গৃহ নির্মাণের৷ মোট ২৩ রকমের ৩৩৭টি অ্যাপার্টমেন্ট থাকবে সেই আবাসনে৷ থাকবে নানা বয়সী হাজার দুয়েক মানুষ৷ তিনি লক্ষ্য করলেন আবাসনের ছাদের মাপ দাঁড়াচ্ছে ৪৫৬ ফুট লম্বা এবং ৬০ ফুট চওড়া৷ তিনি কী করলেন? এই ছাদটাকে ব্যবহার করলেন নানাভাবে৷
ওপন রুফ নার্সারি স্কুল বানিয়ে ফেললেন, যেখানে সিমেন্টের পার্মানেন্ট টেবিল-বেঞ্চি, বানিয়ে ফেললেন এক কোণায় ছোট্ট জিমনেশিয়াম, মেয়েদের আড্ডা মারার পার্ক গোছের বানানো হলো ছাদের এক প্রান্তে৷ অর্থাত্ সব মিলিয়ে ছাদটা হয়ে উঠল এক মাল্টি-পারপাস স্পেস৷ পার্ক-জিম-স্কুল বানানোর যে স্পেসটা প্রকৃতির কাছ থেকে নেওয়ার দরকার ছিল সেটা আর তাকে নিতে হলো না, ফিরিয়ে দেওয়া গেল প্রকৃতিকেই৷'
কিন্তু কলকাতায় তো বাঙালির একটা ছাদ-বিলাস আছে, হারিয়ে যাওয়া চিলেকোঠার ঘর নিয়ে হা-হুতাশ আছে৷ সে ক্ষেত্রে বড়ো-বড়ো মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংয়ের ছাদ ব্যবহার হচ্ছে কীভাবে?
উত্তরে শৈবাল জানাচ্ছেন, 'দেখুন, ইউটিলাইজেশন অফ রুফ আগে এক রকম ছিল৷ মা-ঠাকুমারা ছাদে বড়ি দিতেন, আচার শুকোতে দিতেন, ধুনুচিরা শীতে এই ছাদেই লেপ-তোষক বানাতো, দিনের শেষে বাড়ির মেয়েরা আড্ডা জমাতেন, এ-ছাদ ও-ছাদে ছেলে-মেয়ের প্রেমও কিছু কম দেখেনি কলকাতার ছাদ৷ এখন প্রাইভেট ছাদ প্রায় নেই, সবই বড়ো-বড়ো আবাসনের ছাদ৷
কিন্ত্ত সেই ছাদের ব্যবহারও প্রায় একই রকম রয়ে গেছে৷ অর্থাত্ এখনকার ছাদ ইন্টারঅ্যাকটিভ কমিউনিটি স্পেস৷ টেম্পোরারি স্ট্রাকচার দিয়ে, আউটডোর উড ফ্লোরিং দিয়ে কফি শপ, জিম, রুফ গার্ডেন এবং সে রকম হলে স্যুইমিং পুল পর্যন্ত করা হচ্ছে৷ বর্ষাকাল বাদে পুরোটাই খোলা৷ স্কাই লাইন দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না৷ বর্ষার সময়ে অস্থায়ী ছাউনি দিয়ে ঢেকে দেয়া হচ্ছে৷
এখনতো গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে হু-হু করে৷ আবাসন যতো উঁচু হচ্ছে, ততো আবাসিকদের গাড়ি রাখার জায়গার অভাব হচ্ছে৷ ফলে, কোথাও-কোথাও ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে গাড়ি৷ ছাদটা এক সময় ডাম্পিং গ্রাউন্ড ছাড়া কিছু ভাবা হতো না, এখন সেই ভাবনায় গুণগত পরিবর্তন হয়েছে৷'
কিন্তু ছাদ ঘিরে নস্টালজিয়া? একটু যেন স্মৃতিমেদুর হলেন শৈবাল কর৷ বললেন, 'আমার কাছে ছাদ মানে কিন্ত্ত এখনও ঘুড়ি ওড়ানো, পায়রা ওড়ানো, কাপড় শুকোতে দেওয়া আর ছাদের ঘর৷' আখতারুজ্জামান ইলিয়াস 'চিলেকোঠার সিপাই' লিখে ছাদ-ঘরকে বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব দিয়েছেন৷ 'ঘর মানে বাড়ির চিলেকোঠা৷ ছাদের ওপর একটি মাত্র ঘর৷ রান্নাঘর নাই৷ বাথরুম নাই৷ তবে ওসমানের ঘরে আলো-বাতাস খুব৷ দরজা দুটো৷ সিঁড়ির মুখে একটা, একটা ছাদের দিকে৷ ছাদটা বেশ বড়৷ চারিদিকে রেলিং৷ সামনের রেলিং একটু উঁচু'৷
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/বিএসএস/এসএস