আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বিজ্ঞান ও রাজনীতি দুদিকেই সফল। এমন প্রতিভা ইতিহাসে বিরল। বিদ্যুৎবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতেন তিনি। সেই যুগে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। সে সময় ভয়ংকর এক পরীক্ষায় নামলেন ফ্রাঙ্কলিন।
১৭৪৬ সালে ডাচ বিজ্ঞানী পিটার ভন মুশেনব্রক চার্জ সঞ্চয় করে রাখার জন্য একটা পাত্র তৈরি করলেন। সেটা আসলে কাচের বৈয়ামের মতো দেখতে এক ধরনের জার। সেই জারে চার্জ সংরক্ষণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন মুশেনব্রক।
তিনি তখন লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। মুশানব্রকের সেই চার্জ সংরক্ষণের জারটার নাম হয়ে যায় লেইডেন জার। লেইডেন জারে চার্জ সংরক্ষণ করা যেত ঠিকই। কিন্তু বেশিক্ষণ ধরে রাখা মুশকিল।
চার্জিত লেইডেন জার কোনো কিছুর সংস্পর্শে এলেই খেল খতম! চার্জ জার থেকে পাচার হয়ে চলে যেত সেই বস্তুতে।
তারপর লেইডেন জার নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষা চলল। অনেক বেশি বেশি চার্জ ঢোকানো হলো লেইডেন জারে। চার্জের পরিমাণ বেশি হলে তার পরিণাম কি হয় তা জানতে চাইলেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গেলো, জারে খুব বেশি চার্জ ঢোকালে তখন আর কোনো কিছুর সাথে স্পর্শ করাতে হয় না জারকে।
জার থেকে বাতাসে প্রবাহিত হয় চার্জ। তারপর বায়ু মাধ্যমে পেরিয়ে চলে যায় কাছের কোন বস্তুতে। তখন আরেকটি ঘটনা দেখে অবাক হলেন বিজ্ঞানীরা। জার থেকে চার্জ বায়ু মাধ্যমে ঢোকার পর আলোর ঝলকানি দেখা যায়। তীক্ষ্ণ চচ্চড় শব্দ। চমক জাগানিয়া ঘটনাই বটে।
এমন ঘটনা যে প্রকৃতিতেও ঘটে। আকাশে ঝড়-বাদলের দিনে। মেঘে-মেঘে বিদ্যুৎচমকের ফলে। আলোর ঝলকানি দেখা যায়, সাথে কান ফাটানো আওয়াজ।
তাহলে আকাশেও কি চার্জের ব্যাপার-স্যাপার আছে। মানে বিদ্যুতের খেলা আছে কি-না? কাজে লেগে পড়লেন ফ্রাঙ্কলিন। হাতেনাতে পরীক্ষা করতে চান তিনি। কীভাবে? আকাশের বজ্রকে টেনে নামাতে হবে মাটিতে! দেখতে হবে, তাতে বিদ্যুৎ আছে কিনা?
কীভাবে?
ওপরে উঠে ধরে আনার প্রশ্নই ওঠে না। হেলিকপ্টার-উড়োজাহাজ দূরে থাক, সে যুগের মানুষ বেলুনে চেপে উড়তে পারত কিনা সন্দেহ।
১৭৫২ সাল। ফ্রাঙ্কলিন একটা ঘুড়ি ওড়ালেন। একেবারে মেঘ বরাবর তার ঠিকানা। তবে সাধারণ সুতোর বদলে তাতে ব্যবহার করলেন সুপারিবাহী পদার্থের সুতো। তবে সেটা কী পদার্থের তৈরি, তা জানা সম্ভব হয়নি। নিচেয় একটা লেইডেন জার রেখেছিলেন ফ্রাঙ্কলিন। সেই জারের সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন ঘুড়ির সুতো। ঘটনাটা সাদামাটা মনে হচ্ছে। তবে কিন্তু ভীষণ ঝুঁকির। প্রাণও চলে যেত পারত ফ্রাঙ্কলিনের!
যে অনুমানের ওপর ভর করে ফ্রাঙ্কলিন ঘুড়িকে পাঠিয়েছিলেন মেঘ থেকে বিদ্যুৎ চুরি করতে, সেটাই যে সত্যি প্রমাণিত হলো! ঘুড়ির সুতো বেয়ে মেঘ থেকে লেইডেন জারে জমা হলো বিদ্যুৎ।
ফ্রাঙ্কলিন সেই বিদ্যুৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রমাণ করলেন অনুমানের সত্যতা। নিশ্চিত করলেন, লেইডেন জারের জমা চার্জ যখন বায়ু মাধ্যমে প্রবাহিত তখন দেখি আলোর ঝলকানি আর শুনি তীক্ষ্ণ শব্দ।
তবে সেই ঝলকানি নিজে বিদ্যুৎ নয়। বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় বিদ্যুৎ বাতাসকে উত্তপ্ত করে। তারই ফলে জন্ম হয় এই আলোর ঝলকানি আর তীক্ষ্ণ শব্দের।
ফ্রাঙ্কলিন নিশ্চিত করলেন, আকাশের বৈদ্যুতিক ঝলকেও তৈরি হয় এমন চার্জ। সেই চার্জ বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে এবং তীব্র শব্দের জন্ম দেয়। সাথে চোখ ধাঁধানো ঝলকানি। অর্থাৎ পৃথিবীর বিদ্যুৎ আর আকাশের বিদ্যুতের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।
বজ্রপাতের কারণ যে বিদ্যুৎ, সে কথা না হয় জানা ছিল না বিজ্ঞানীদের। কিন্তু বর্জ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা তো তখন ঘটত অহরহ। তাহলে সব বুঝে কেন ঝুঁকি নিতে গেলেন ফ্রাংকলিন? না নিলে যে, বর্জ্রপাত যে বিদ্যুতের খেলা সেটা তো জানা হতো না! বিজ্ঞানীরা এমন হঠকারি সিদ্ধান্ত নেন বলেই মানুষের জীবন-যাপন এতটা সহজ হয়ে উঠেছে। সূত্র : বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন হিস্ট্রিক্যাল সোসাইটি