আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মহাকাশে নরককুণ্ড বলা যেতে পারে কোন বস্তুটিকে। অনেকে হয়তো বলবেন ব্ল্যাকহোল কিংবা সূর্যের মতো নক্ষত্রদেরকে। কিন্তু নরককুণ্ড আরো থাকতে পারে। হতে পারে সেটা একটা গ্রহ।
২০০৪ সালে আবিষ্কার হয় একটা নারকীয় গ্রহ। বিজ্ঞানীরা সেই গ্রহটির নাম দেন ৫৫ ক্যানক্রি ই। পৃথিবীর চেয়ে আট গুণ বড় এই গ্রহটি।
কেন এটাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে?
পৃথিবীর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলেই যেখানে আমাদের নাভিশ্বাস ওঠে, সেখানে এই গ্রহটির দিনের তাপমাত্রা আড়াই হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি! ভাবা যায়, কী অবস্থা?
ভয়ংকর উত্তপ্ত এই গ্রহের আচরণ বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তায় রেখেছে এত দিন। গ্রহটি থেকে কখনো শুধু অদৃশ্য অবলোহিত বা ইনফ্রারেড আলো আসে, কখনো এর সঙ্গে আসে দৃশ্যমান আলোও। কেন এমন হয়?
সম্প্রতি সুইজ্যারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড প্ল্যানেটরি সায়েন্সের অধ্যাপক কেভিন হেঙ জানিয়েছেন, নাসার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপই পারবে সেই গ্রহ থেকে আসা রহস্যময় সিগন্যালের ব্যাখ্যা করতে। এ বিষয়ে তিনি একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে।
৫৫ ক্যানক্রি ই গ্রহটি পৃথিবী থেকে চল্লিশ আলোক বর্ষ দূরে।
তার মানে সেখান থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছতে সময় লাগে ৪০ বছর। গত দুই দশক ধরে বিজ্ঞানীরা লক্ষ করছেন গ্রহটির অদ্ভুত সব আচরণ। কখনো গ্রহটির বায়ুমণ্ডল ছোট হচ্ছে, কখনো বা বেড়ে যাচ্ছে বায়ুমণ্ডলের আকার।
অর্থাৎ গ্রহটিতে পর্যায়ক্রমে বায়মুণ্ডলের গ্যাস পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। তার পরই আবার এর পৃষ্ঠ থেকে আগ্নেগিরির লাভা বিস্ফোরণ শুরু হয়। তৈরি করে উত্তপ্ত বায়ুমণ্ডল।
এর কারণ কী?
উত্তর যে বিজ্ঞানীদের একেবারেই অজানা, তা কিন্তু নয়। গ্রহটি তার মাতৃনক্ষত্র থেকে খুব কাছের কক্ষপথে ঘুরছে। পৃথিবী থেকে সূর্যের যে দূরত্ব, এর মাত্র ২% দূরত্ব থেকে মাতৃনক্ষত্রের কক্ষপথে ঘুরছে ৫৫ ক্যানক্রি ই। মাত্র ১৭ ঘণ্টায় গ্রহটি পুরো কক্ষপথ একবার ঘুরে আসে, যেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে লাগে ৩৬৫ দিন! মাতৃনক্ষত্রের এত কাছে বলেই নরকের মতো চরম পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গ্রহটিতে।
দিনের বেলা মানে যে অংশে নক্ষত্রের আলো পড়ে সেই অংশের তাপমাত্রা উঠে যায় ২৪২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাতে যখন অন্ধকার তখনো এর তাপমাত্রা ১১২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তবে গ্রহটির সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার হলো, এর থেকে আসা সিগন্যাল, যার কথা আগেই বলেছি। সম্প্রতি অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে কেভিন হেঙ এমন অদ্ভুত সিগন্যালের বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর বলেছেন, তাঁর ব্যাখ্যার প্রমাণ দিতে পারে শুধু মহাকাশে স্থাপিত জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ।
গবেষকেরা বলেন, নক্ষত্রের এত কাছে থাকে বলে এর পৃষ্ঠে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। অতি তাপমাত্রায় গ্রহটির বুকে ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরিগুলোর মুখ খুলে যায়। তখন প্রচণ্ড বেগে লাভা উদগিরণ করে। তখন কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যায় গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে।
বায়ুমণ্ডলে নানা রকম গ্যাসীয় পদার্থও ছড়িয়ে পড়ে, তখন ঘন একটা বায়ুমণ্ডল তৈরি হয়। কিন্তু অতি তাপমাত্রার কারণে ক্রমেই বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব কমতে থাকে। একসময় বায়ুমণ্ডল এতটাই হালকা হয়ে যায়, গ্রহটির মহাকর্ষ বল সেই বায়ুমণ্ডলকে ধরে রাখতে পারে না, মহাশূন্যে মিলিয়ে যায় গ্যাসগুলো। নতুন করে আবার আগ্নেয়গিরির মুখ খোলা পর্যন্ত গ্রহটি বায়ুমণ্ডলশূন্য থাকে।
হেঙ দাবি করেছেন, গ্রহটির এই চরম অস্থিতিশীল আবহাওয়ার কারণেই এর থেকে অদ্ভুত সিগন্যাল আসে। যখন গ্রহটিতে উত্তপ্ত বায়ুমণ্ডল থাকে, সেখান থেকে তখন দৃশ্যমান আলো নির্গত হয়। একই সঙ্গে এর পৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত অবলোহিত বা ইনফ্রারেড রশ্মি বিকিরিত হয়।
তখন দুই ধরনের সিগন্যালই পৃথিবীতে আসে। কিন্তু যখন এর বায়ুমণ্ডল থাকে না, তখন এর উত্তপ্ত পৃষ্ঠ থেকে আসা অবলোহিত রশ্মিই শুধু পৃথিবীতে আসে। এ কারণেই গ্রহ থেকে আসা সিগন্যালের এমন তারতম্য দেখা যায়।
কেভিন হেঙ সিগন্যালের এই অদ্ভুত আচরণের যে ব্যাখ্যা তিনি দিচ্ছেন, এটা তাঁর ধারণাপ্রসূত। নিশ্চিত করে বলার সময় এখনো আসেনি। তবে নিশ্চিত করার জন্য একটা পরীক্ষার উপায় বাতলে দিয়েছেন হেঙ।
তাঁর মতে, মহাকাশে স্থাপন করা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নভোদূরবীক্ষণ যন্ত্র জেমস ওয়েব টেলিস্কোপই পারে এ ধারণার প্রমাণ দিতে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের সাহায্যে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলের চাপ, তাপমাত্রা ইত্যাদির চুলেচেরা বিশ্লেষণ করলেই হয়তো তাঁর ধারণার প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁদের ওপর নির্ভর করছে হেঙয়ের এই ধারণা প্রমাণ করার জন্য জেমস ওয়েবকে ব্যবহার করা হবে কি না।
সূত্র : James Webb Space Telescope could have explained the mysterious signals from ‘hell planet’ 40 light-years away/Space.com