এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : প্রথম সন্তান, প্রথম মা, প্রথম বাবা হওয়া মানেই চারিদিকে পৃথিবীর সকল সুখ ও আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়া৷ পরিবারের অন্য সদস্যরাও আনন্দে মুখর হয়ে থাকে। বিশেষ করে এখনকার বিবাহিত মহিলারা নিজেদের সম্পর্কে এবং সন্তান হওয়ার পর সন্তান সম্পর্কে, আগেকার কালের নারীদের চেয়ে বেশি সচেতন ।
সচেতন তাদের স্বামী এবং পরিবারের অন্যান্যরাও । সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং শিক্ষার প্রভাবে মানসিকতায় এই যে পরিবর্তন তা খুবই কাম্য ছিল, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নতুন মায়ের সংসার
বাড়িতে ছোট্ট নতুন মানুষের আগমনে এক অনাস্বাদিত আনন্দের ঢেউ খেলে যায় । কিন্তু,এর অন্তরালে আরও অনাস্বাদিত অনুভূতিও উঁকি মারে। প্রথমেই যে সমস্যা হয় সেটি হল (চেতনাতে না হলেও, অবচেতনে অনেক ক্ষেত্রে হয়) নবাগতটির সঙ্গে মানিয়ে চলা ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, নিজের সদ্যোজাত সন্তানের সঙ্গে আবার মানিয়ে চলা কি বস্তু? আসলে সন্তানটি আদরের নিশ্চয়, কিন্তু তার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে যে কয়েকটি সমস্যার উদয় হয় তা অনেকে বুঝে উঠতে পারেন না। অনেক মহিলাই হয় ঘুমকাতুরে, আর সন্তানের জন্মের পর মেয়েদের প্রধান সমস্যা হয় ঘুমের ।
কারণ নতুন মানুষটি তখন প্রায় ‘জেট-ল্যাগে’ ভুগছে। তার দিন-রাতের হিসেব প্রকৃতপক্ষেই গণ্ডগোল হয়ে যাওয়ায় মায়ের ঘুমের কোনও ঠিক থাকে না । এ তো গেল ঘুমের সমস্যা। এ ছাড়াও বচ্চার জন্য এমন বহু কাজ করতে হয়, যেগুলি সঙ্গত কারণেই আগে কখনও করতে হয়নি, ফলে এই কাজগুলির সঙ্গে সমঝোতা করাটাও অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
সন্তানের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যাগুলি থাকবেই । তাই তার মোকাবিলা কিভাবে করা হবে তা মাথায় রেখে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে প্রসূতি তার সন্তানের জন্য অবশ্যই লোক রাখতে পারেন কিংবা বাড়ির লোকও বাচ্চার কাজে সহায়তা করতে পারেন, কিন্তু নতুন মাকেই তার সন্তানকে দেখার মূল দায়িত্ব নিতে হবে। আর সন্তান পালন মানে কেবল তাকে খাওয়ানো নয়। তাকে তেল মাখানো, স্নান/গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো ইত্যাদি যে সকল কাজে শিশুটির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয় তেমন কাজ করা প্রয়োজন।
বাকি কাজ যেমন বচ্চার জামাকাপড় কাচা, শুকোতে দেওয়া, বিছানা ঠিক করা এসব কাজে অবশ্যই অন্য লোক দরকার কারণ একা মায়ের পক্ষে এত কাজ কিছুতেই সম্ভব না। যেহেতু এই সময় ঘুম কম হয়, অথচ মায়ের ঘুমের প্রয়োজন অত্যধিক, তাই সম্ভব হলেই প্রসূতি একটু ঘুমিয়ে নেবেন। সেক্ষেত্রে, বাড়ির অন্য লোকদেরও প্রসূতিকে সাহায্য করতে হবে। টেলিফোন, কলিং বেল এগুলিতে সাড়া দেবার জন্য পরিবারের অন্য লোকেদের সজাগ থাকা উচিত।
দুপুরবেলা বেবিকে অন্য আত্মীয়ার কাছে রেখে মা অবশ্যই কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেবেন । এই সময় মেয়েদের আর একটি সমস্যা দেখা দেয়। সন্তান ধারণের সময় মেয়েদের ওজন বাড়ে, সন্তান জন্মের পরও বেশ কিছুদিন ওজন স্বাভাবিকের থেকে বেশিই থাকে। অনেক মহিলা এতে উদ্বিগ্ন হন, বিষাদে ভোগেন ।
বাড়ির লোকেদের এই সময়ে নতুন মাকে সাহায্য করা দরকার। স্বামী তো বটেই, শাশুড়ি, ননদ, জা, মা, বোন এনাদের কাজ হল প্রসূতিকে বোঝানো যে, চেহারা এই সময় তন্বী বা আকর্ষক হয়ত নাও থাকতে পারে, কিন্তু মাতৃত্বের লাবণ্যও তুলনাহীন । আর এই ভারি চেহারা সাময়িক, পরে আবার চেহারা স্বাভাবিক হয়ে যায় । নতুন মা যদি গৃহবধূ হন তাহলে তো বাড়িতেই থাকেন, চাকরি বা বাইরের কাজ করলেও এই সময়ে মেয়েরা তো মেটারনিটি লিভেই থাকেন।
গৃহবধূরা বাড়িতে যে স্বাভাবিক কাজকর্ম করেন সন্তান হওয়ার পর তাতে ব্যাঘাত ঘটে, এদিকে কর্মরতা নতুন মায়ের মনে হতে পারে বাড়িতে যখন আছিই তখন সবার জন্য কিছু না কিছু করা দরকার, অথচ কার্যক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে না আর এতে প্রসূতির মনে শঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে উৎকণ্ঠাও দেখা দিতে পারে। মনে হতে পারে তিনি তার বাড়ির লোকের সঠিক যত্ন করতে পারছেন না, ফলে তাঁদের অবহেলা হচ্ছে, ঘরের মানুষও হয়ত খুব অবহেলিত বোধ করছেন।
এক্ষেত্রে প্রসূতিকে মনে রাখতে হবে যে তার জীবনের এই নতুন অধ্যায়ে গুরুত্ব কি? কোন কোন বিষয়ের ওপর প্রাধান্য আরোপ করতে হবে তা অবশ্য বিচার্য । আর বিচারের পর অবশ্যই সবাই সহমত হবেন যে সন্তানের যত্ন এবং তারপর বহু মহিলাই ‘নিজের যত্ন’ শুনে আঁতকে উঠবেন কারণ তাদের কাজের ফর্দে ‘নিজের যত্ন’ হয় একেবারে শেষে থাকে বা থাকেই না ।
যেমন ঘুম সঠিক হলে বুকে দুধ বেশি হয় বা পুষ্টিকর খাবার সঠিক পরিমাণে খেলে শরীর তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে এইরকম আরকি । তাই এই সময় অন্যদের তেমন যত্ন না নিতে পারলে সেটা খুব দোষণীয় অপরাধ নয় । তবে নেহাতই যদি মন খুঁত খুঁত করে তাহলে খাবার টেবিলে বসা, জামাকাপড় গুছিয়ে দেবার মত হালকা কাজ করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও কোনও ক্ষেত্রে এক নতুন সমস্যা দেখা দিতে পারে । সন্তান প্রসবের পর অনেকে বুঝতে পারেন ন স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্ক ঠিক কিরকম হওয়া উচিৎ এবং এই নিয়ে অনেক ভুল ধারণা থাকে — সেক্ষেত্রে যে ডাক্তার ডেলিভারি করিয়েছেন তার সঙ্গে দুজনেরই কথা বলে নেওয়া উচিত এই সময় যুগ্ম সম্পর্ক কেমন হবে সেই ব্যাপারে।
নতুন মায়ের খাওয়া দাওয়া
প্রথমেই বলা ভাল যে, এই সময় মায়ের স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৫০ ক্যালরি বেশি লাগে — বিশেষত বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর কারণে। বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মায়ের সুষম আহার একান্তভাবে দরকার। বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে, কোনও পুষ্টি যেন বাদ না পড়ে যায় । সাধারণত একজন মহিলা যে খাবার খান, সেই হিসাবে নতুন মায়ের খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ হতে হবে বেশ বেশি । ডায়েট চার্ট তৈরি করে নিতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী । বাচ্চা হবার পর প্রথম ছ মাসে অতিরিক্ত ৬৫০ ক্যালরি লাগবে, তার পরের ছ মাসে লাগবে অতিরিক্ত ৫০০ ক্যালরি।
এই বেশি ক্যালরি পাওয়ার জন্য দৈনন্দিন সুষম খাদ্যতালিকার ওপরই নির্ভর করতে হবে । ভাত, মুড়ি, চিঁড়ে, ডাল বা ডাল থেকে তৈরি খাদ্য যেমন ছাতু, বেসন, ছোলা ভেজানো, প্রচুর শাকসবজি খেতে হবে। রঙিন সবজি যেমন গাজর, টম্যাটো খাওয়া দরকার । স্তন্যপায়ী শিশুর কাছে ভিটামিন এ ও সি-র একমাত্র উৎস মায়ের দুধ ।
তাই ফল খাওয়া মায়ের পক্ষে বিশেষ জরুরি । অনেকের ধারণা, মা যদি লেবু জাতীয় সাইট্রাস ফুড খান তাহলে অ্যাসিডিটি হবার সম্ভাবনা থাকে । এ ধারণা ভ্রান্ত, বরং জল ও জলীয় উপাদান সমৃদ্ধ খাবার বিশেষ উপকারি জল অন্তত দশ গ্লাস খেতে হবে সারাদিনে, তাহলে দুধের প্রবাহ সহজ থাকে। যারা মাছ মাংস খান না, তাঁরা দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার যেমন টক দই, ছানা, চিজ এসবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবেন খাদ্য তালিকায় ।
আমিষাশীরা মাছ, মাংস, ডিম তো খাবেনই, পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল ও মাখনও খাবারে থাকা দরকার । ক্যালসিয়াম এই সময়ে বিশেষভাবে খাবারের অন্তর্ভুক্ত করতেই হবে। কারণ, এর অভাবে মায়েদের স্বাস্থ্য হানি হবার ভয় আছে । যেভাবেই হোক খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে ।
আমাদের ঠাকুমাদের আমলে আঁতুড়ে প্রসূতিকে দুধ সাবু বা ঘি মরিচ দিয়ে ভাত খাওয়ানোর যে রেওয়াজ ছিল তা খুবই স্বাস্থসম্মত ও বৈজ্ঞানিক, কারণ এর থেকে ক্যালরি বেশি পাওয়া যায় । বাড়ির স্বাভাবিক কাজকর্ম করলেই খিদে বাড়বে ।
আর কিছু ওষুধ যা ডাক্তার দেবেন সেগুলির নিয়মিত ও যথাযত সেবন দরকার । মায়ের খাদ্য তালিকায় থাকবে পরিমিত তেল মশলার খাবার, বেশি ভাজাভুজি বাদ । অ্যালকোহল না, সিগারেট না — কৃত্রিমভাবে রঙ করা খাবার বা সুগন্ধ দেওয়া খাবারও খাওয়া উচিৎ নয়৷
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই/