এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : মিশরের রাজধানী কায়রোর ডাউন-টাউনে অবস্থিত মিলনকেন্দ্র ও চত্ত্বরটির নাম তাহরির স্কয়ার। এটি "শহীদ চত্ত্বর" নামেও পরিচিত। ১৯শতকের ডাউন-টাউন জেলার 'প্যারিস অন দ্যা নাইল'-এর রূপকার খিদিভ ইসমাইল-এর নামানুসারে "ইসমালিয়া স্কয়ার" হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কয়ারটি ১৯১৯ সালের মিশর বিপ্লব-এর পর সর্বপ্রথম "তাহরির স্কয়ার" বা মুক্ত স্কয়ার" নামে পরিচিত লাভ করলেও তখন এই বিষয়ে কোনো সরকারিভাবে পুনঃনামকরণ করা হয়নি; কিন্তু রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে উত্তোরনের ১৯৫২ সালের মিশর বিপ্লব-এর পর এটিকে পরিবর্তন করা হয়। এই চত্ত্বরটি ২০১১ সালের মিশর বিপ্লব-এর সময় সবার মনোযোগের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়।
এক বছর আগে এই তাহরীর স্কয়ারে শহিদ হন মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের সিনিয়র নেতা ড. মোহাম্মদ আল-বেলতাগির মেয়ে আসমা আল-বেলতাগি রাবা আল আদাবিয়ার।
মিসরে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে যে সমাবেশ হয়েছিল, তাতে তিনিও হাজির ছিলেন। নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে তিনি শহিদ হন। সম্প্রতি শাহাদাতের এক বছর অতিবাহিত হলো। এ উপলক্ষে ড. মোহাম্মদ আল-বেলতাগি তার শহিদ মেয়ের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেছেন।
তার সেই চিঠিটি ১৩ আগস্ট প্রকাশিত হয় মিডলইস্ট মনিটরে।
প্রিয় মেয়ে আমার শিক্ষক, আমার আদর্শ এবং আমার জীবনের প্রেরণা;
এক বছর আগে আল-উখদুধ (পরিখা) এবং মহান কারবালা দিবসের মতো কালো ইতিহাস সৃষ্টিকারী দিনে তোমার পবিত্র রুহ শহিদদের কাফেলার সাথে ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ করেছে। নিষ্কলুস রুহ বেহেশতে পাড়ি জমায় সত্যের প্রতি একনিষ্ঠ এবং তাতে অটল থাকা এবং সব ধরনের নির্যাতন, নিষ্পেষণ, অবিচারের ঊর্ধ্বে তুলে ধরা এবং নির্যাতন ও নির্যাতনকারীর নিন্দা করার মূল্য হিসেবে। রসধমবং (৯৩)
মাগো! কয়েক দিন আগে কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়ার জন্য মাধ্যমিক স্কুলের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। আমি তোমার সহকর্মীদের (যেখানে তুমি সবসময় অন্যদের ছাপিয়ে গেছ এবং সফল হয়েছ) প্রতি খুশি ছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল তোমার স্থানটি গ্রহণ করে তাদের অভিনন্দন জানাবার। তবে আল্লাহর কসম, ‘আল্লাহ যাদেরকে নবি, আওলিয়া, শহিদ ও সত্যনিষ্ঠ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন’, তোমাকে ‘অতি অল্প কয়েকজনের’ সাথে সেই সর্বোচ্চ কাতারের রেখে তোমাকে সম্মানিত করার মাধ্যমে তোমার প্রতি আল্লাহ যে রহমত দান করেছেন, তাতে আমি আরো বেশি খুশি হয়েছি।
মাগো!
কেবল আল্লাহই জানেন আমি তোমার হাসিমাখা সুন্দর মুখ, তোমার মমতাময়ী উপস্থিতি, তোমার বুদ্ধিদীপ্ত মননকে কত মিস করছি। অবশ্য, তুমি সবসময় আমাদের সাথেই আছ, তুমি কখনো আমাদের ছেড়ে যাওনি। একবার তোমার মা কারাগারে আমার সাথে দেখা করতে এসে কসম কেটে বলেছিল যে আসমা এখনো আমাদের সাথে আছ। আমি তার সাথে একমত প্রকাশ করে বলেছিলাম, হ্যাঁ, ‘তারা তাদের প্রভুর সাথে থাকে, তিনি সবকিছুর পর্যাপ্ত যোগানদাতা।’ তোমার মা আমার দিকে ফিরে বলেছিল, ‘ও (আসমা) সত্যিই আমাদের কথা, কাজের সাথে আছে, আমাদের সংগ্রামে সে অংশ নিচ্ছে, আমাদের জীবনেও আছে সে।’ তোমার মা আমাকে অনেক তরুণ, তরুণীর গল্প শোনাল। তারা তাকে বলেছে, তারা যখনই কোনো সমস্যায় পড়ে বা কোনো সঙ্কটের মোকাবিলা করে, আসমা স্বপ্নে হাজির হয়ে তাদের আশ্বস্ত করে, সুসংবাদ দেয়, উপদেশ দেয়, কোনটা ভালো সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়, সঙ্কট অতিক্রম পর্যন্ত তাদের সাথেই থাকে। আমি নিজেকে বলি, কী খুশির কথা, আমার প্রিয় মেয়ে, তুমি বেঁচে থাকতে এবং শহিদ হওয়ার পরও তুমি কতই না আন›“ায়ক।
আমার নয়নের মণি!
আমাদের প্রিয়জনদের খুন করা, আমাদের এবং আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা ও মামলা করা, আমাদেরকে অধিকারচ্যুৎ করা, আমাদেরকে শিক্ষকতার চাকরি থেকে বরখাস্ত করা, দুর্নীতিবাজ বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা, মিথ্যা অভিযোগে আমাদের বিপুলসংখ্যক সন্তানকে কারারুদ্ধ করার মতো নানা ঘটনা সত্ত্বেও আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা তোমাকে বা তোমার সাথে শহিদ হওয়া ভাইবোনদের একটি সেকেন্ডের জন্যও ভুলিনি। তোমরা যে কারণে আত্মত্যাগ করেছ, সেটাও আমরা ভুলিনি।
আমার মেয়ে, আমার শিক্ষক এবং আমার নয়নের মণি!
এক বছর আগে তুমি আমাদের ছেড়ে গেছ। তোমাকে ছাড়া জীবন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। আমরা আর জেল বা জেলারের ভয়ে ভীত নই, কিংবা খুন হওয়া বা ফাঁসিতে ঝোলা নিয়ে কোনো আতঙ্ক নেই। তুমি তোমার পবিত্র রক্ত এবং নির্ভেজাল বিশ্বস্ত আত্মা দিয়ে আমাদের শিখিয়েছ আল্লাহর রাস্তায় কিভাবে কোরবানি করতে হয়, কিভাবে সত্য, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে হয়।
পরিশেষে, আমরা নিয়মিত তোমার ও তোমার সাথী শহিদ ভাইবোনদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ বেহেশতে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজনদের মাঝে স্থান দেন। আমরা তাঁর কাছে অনুরোধ করছি তিনি যেন মহানবী হযরত মোহাম্মদের (সা.) এবং তার সাহাবিদের সাথে থাকা তোমার সাথে যোগ দেয়ার আগে পর্যন্ত ধৈর্য ও দৃঢ় থাকতে পারি সে শক্তি আমাদের দেন, যেন তাঁরা এটা জেনে খুশি হন যে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম আল্লাহর প্রদত্ত দায়িত্ব কোনো ধরনের দ্বিধা ছাড়াই পালন করেছে।
আমার মেয়ে ও আমার শিক্ষক!
আল্লাহর ইচ্ছা ছিল যে বিশেষ করে ওই স্মরণীয় দিনে সেনাবাহিনীর গুপ্ত হামলাকারীদের হাতে তোমার নিহত হওয়াটা তুমি যে সত্যনিষ্ঠ ও ন্যায়নিষ্ঠ পথ আঁকড়ে ছিলে যেজন্য তুমি মারা গেলে তার চিহ্ন ও প্রমাণে পরিণত হবে। ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নির্যাতন, দুর্নীতি, প্রত্যাখ্যান ও অধীনস্ত করার মাধ্যমে দেশকে ধবংস করার যে সামরিক শাসন চলছিল সেটার অবসানের লক্ষে হয়েছিল জানুয়ারি বিপ্লব। কিন্তু ওই দিন বিপ্লবের সম্পূর্ণ বিপরীতে ফের সামরিক শাসনের প্রত্যাবর্তন ঘটে। তোমার নিহত হওয়াটা এটাই প্রমাণ করে যে যারা সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় প্রতিবাদ করছিল, তারা কোনো গ্রুপ বা ব্যক্তির হয়ে কাজ করছিল না। তুমি ছিলে তাদের মধ্যে শেষ ব্যক্তি যারা কখনো কোনো দলীয় আনুগত্য, কোনো ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট কোনো পার্টির অনুকূলে কাজ করেনি। বিশেষ করে সেনাবাহিনীকে অযৌক্তিক ছাড় দেয়ার ক্ষেত্র, বিশেষ করে যখন বিপ্লবী শহিদদের প্রতি ন্যায়বিচারের স্বার্থের বিষয় আসত, তখন প্রায়ই তুমি ব্রাদারহুডের সিদ্ধান্তের সাথে ভিন্ন অবস্থান ব্যক্ত করতে।
তুমি তো কখনো অস্ত্র হাতে তুলে নাওনি, এমনকি পাথর পর্যন্ত না। কাজেই তোমার নিহত হওয়াটা সন্দেহাতীতভাবে এই প্রমাণ দেয় যে যারাই অভ্যুত্থানকে ‘না’ বলেছে এবং যারাই নির্যাতন ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তাদের সবাইকে টার্গেট করা হয়েছে। তোমাকে হত্যা করাটা ছিল ভয়াবহ ধরণের বিশ্বাসঘাতকতা আর ষড়যন্ত্রমূলক কাজ। তোমাদের মাথার ওপর চক্কর দিতে থাকা হেলিকপ্টার বা স্কয়ারে ছড়িয়ে থাকা সেনাবাহিনীর চোরাগুপ্তা হামলাকারীরা তোমাকে খুন করেছে। সামরিক শক্তির ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিক ব্যবহারকারী সামরিক স্বৈরাচারদের বিরোধিতাকারীদের ন্যায়নিষ্ঠতা, সত্যনিষ্ঠতা ও বস্তুনিষ্ঠতার প্রমাণ এটা। অথচ জনসাধারণ তাদের শক্তি ব্যয় আর জীবিকা থেকে প্রাপ্ত অর্থ জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য (তাদের নিজেদের নির্দোষ সন্তানদের হত্যা করার জন্য নয়) ব্যয় করেছে এই সামরিক শক্তি গঠনের পেছনে। অথচ সামরিক বাহিনী তার সামরিক শক্তি ব্যবহার জনগণকে হত্যা করতে, তাদের ওপর কর্তৃত্ব ও দুর্নীতি চাপিয়ে দিতে।
আল্লাহর কসম, আমাদের ওপর যে অবস্থা চেপে বসেছে বা আমরা দুর্বল বা পরাজিত হওয়ার কারণেও আমরা এমনকি দুঃখ পর্যন্ত অনুভব করি না। এখানে আমরা তোমার পথে চলেছি, দুটি মহান লক্ষের [বিজয় বা শাহাদাত] একটি অর্জন না করা পর্যন্ত কোনো কিছুই আমাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে না। আল্লাহর কসম, গত বছরের দিনগুলো এবং অভ্যুত্থানকারীরা যা করেছে (জনগণকে সন্ত্রস্ত্র করে চুপ ও আতঙ্কিত রাখতে ষড়যন্ত্র, খুন, নির্যাতন, চুরি ও অগ্নিসংযোগ; দেশজুড়ে তারা যে হীন কৌশল, মিথ্যা, বিভ্রান্তি ও ষড়যন্ত্র ছড়ানো) তাতে আমাদের মনে এই বিশ্বাসই জোরদার করেছে যে আমরা সত্যের পথে রয়েছি আর তারা রয়েছে মিথ্যার পথে। আমি নিশ্চিত যে আমাদের জয় অত্যাসন্ন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই/