সন্তানহারা এক মা যেমন লিখেছেন, ‘আমি ওর বেঁচে থাকার কথা মনে করেই বেঁচে থাকি, ওর মরে যাওয়ার কথা নয়।’ চিঠির প্রাপক মেয়ের অজ্ঞাতপরিচয় খুনি, খুন হয়ে যাওয়া মেয়ে আর তাঁর নিজের পরিচয়ও জানাননি চিঠির লেখক এই মা। এ জন্যই হয়তো এই চিঠি আরও বেশি আমাদের সবার হয়ে উঠতে পারে।
শনিবার দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এই খোলা চিঠিটি এমটিনিউজের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।
আমার মেয়ের খুনির প্রতি
আমার ফুটফুটে আদুরে মেয়েটার বয়স তখন সতেরো। তোমার গাড়িতে লিফট নেওয়ার ভুল না করলে স্কুলের শেষ-টার্ম শুরু করার কথা ছিল ওর। চারুকলায় ভর্তি হওয়ার জন্যও ও নিজেকে তৈরি করছিল। ওই গরমের ছুটিতেই ছাত্রছাত্রীদের একটা ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছিল ও। আর ওখানে যাওয়া নিয়ে সারাক্ষণই যেন উত্তেজনায় ছটফট করছিল মেয়েটা। কতকিছু নিয়েই না ওর স্বপ্ন ছিল। ও ছিল স্বাভাবিক সরলতায় ভরা এক কিশোরী, কখনো আত্মবিশ্বাসী, কখনো হয়তো একটু রগচটা, কিন্তু এমনিতে লাজুক ও একটু আত্মভোলা।
তোমার সঙ্গে কখনো দেখা হলে আমি তোমাকে প্রশ্ন করতে চাইতাম, কেন? কেন তুমি ওকে খুন করলে এবং ওর লাশ লুকিয়ে ফেললে? খেলা শেষে আর না-চাওয়া একটা ভাঙা পুতুলের মতো ওকে তুমি ছুুড়ে ফেললে। বনের মধ্যে তুমি ওর লাশ লুকিয়ে ফেললে, আমরা জানলাম না আমাদের মেয়ে কেন সে রাতে বাড়ি ফিরে আসেনি, ফিরল না কোনোদিনই। দুই বছর ধরে আমাদের, ওর পরিবারের মানুষজনের কী ভীষণ যন্ত্রণার মধ্যে তুমি রেখে দিয়েছিলে। কেন এমন জঘন্য নির্মমতা করা থেকে তুমি নিজেকে সামলাতে পারলে না? তোমার ছোটবেলায় বা তোমার জীবনে কি কেউ তোমার সঙ্গে অমানুষের মতো আচরণ করেছিল? তোমাকে মানুষ গণ্য না করে, একজন ব্যক্তি হিসেবে গণ্য না করে কেবলই জড় বস্তু বা মাংসপিণ্ড মনে করেছিল?
ক্ষমাশীলতার বিষয়ে অনেক কথা লেখা থাকে আর এমন পরিস্থিতিতে সেসব সামনে আসে, কিন্তু তোমাকে ক্ষমা করার ক্ষমতা ওর থাকলেও থাকতে পারে, আমাদের নেই। আমরা কীভাবে তোমাকে ক্ষমা করব, যেখানে আমরা জানিই না যে তুমি কে? যে কষ্ট, যে যন্ত্রণা তুমি ওকে দিয়েছ, সে সবের জন্য আর ওর বেঁচে থাকার এতগুলো বছর জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার জন্য ও কি তোমাকে ক্ষমা করত? শেষ পর্যন্ত এসব কথাবার্তা আমার কাছে চূড়ান্ত রকমের তত্ত্ব-কথাই মনে হয়। আমি কখনোই ওকে ভুলে থাকতে পারি না। আমি যতক্ষণ জেগে থাকি ও আমার সঙ্গেই থাকে। অনেক সময়ই মাঝরাত পেরিয়ে যায়...আমি ঘুমাতে পারি না, তুমি পারো?
আমি ওর বেঁচে থাকার কথা মনে করেই বেঁচে থাকি, ওর মরে যাওয়ার কথা নয়। এটা অনেক সময়ই খুব কঠিন।
এই বসন্তকালে, ওর মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিবারের মানুষজন আর ওর বন্ধুদের কয়েকজন মিলে আমরা ওর কবরের কাছে জড়ো হয়েছিলাম। আমরা সবাই মিলে ওর সঙ্গে আমাদের সব স্মৃতি আর ওর বেঁচে থাকার দিনগুলো উদযাপন করতে চেয়েছি। আমরা সবাই-ই চেয়েছি কীভাবে ও চলে গেল তা দূরে সরিয়ে রেখে প্রাণোচ্ছল ফুটফুটে কিশোরীটাকে মনে করতে। আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে তাঁর জীবন নয় শুধু, তাঁর মৃত্যুর পরিস্থিতিকে ঘিরে স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাইবে?
ওর বন্ধুরা যখন ওদের লেখা, ওদের পাঠানো ওর চিঠি-পোস্টকার্ড থেকে খানিকটা করে পড়ে শোনাচ্ছিল, ও যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল। ছুটি শেষে ওর স্কুলে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। স্কুলের ধরাবাঁধা রুটিনে বন্দী হতে খানিকটা অনিচ্ছুক এক কিশোরী মনের ছবিও যেন ফুটে উঠছিল এসব স্মৃতিতে। ও বন্ধুদের চিঠি লিখে জানিয়েছিল যে, ও ক্লাসের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হয়েছে এবং এ জন্য হোস্টেলে আলাদা পড়ার ঘরও পাবে ও! এইসব টুকরো টুকরো স্মৃতির মধ্য দিয়ে ও সেদিন জীবন্ত হয়ে উঠছিল। আর ওই দিনই যেন ওর মৃত্যুর অনেক দিন পরে জন্মানো ভাগনে-ভাগনিদের কাছে জন্ম হলো ওর! ছোট্ট বাচ্চাগুলোর মনে সেদিন ওদের এই না-দেখা, না-থাকা খালার জীবন একটা সত্য হয়ে উঠেছিল। সেদিনের পর থেকেই বাচ্চাগুলো এই খালার কথা নিয়ে সবার কাছে জানতে চায়।
কিন্তু তোমার জীবনে কী ঘটল? তুমি হয়তো অনেক আগেই মরে গিয়েছ কিংবা অন্য কোনো অপরাধের কারণে জেলখানায় আছ। হয়তো তুমি একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটিয়েছ এবং সবার কাছ থেকে তোমার অপরাধ লুকিয়ে রেখেছ। তুমি অবশ্যই জানো, যেমন আমরা প্রত্যেকেই জানি যে, খুনের মামলা কখনোই তামাদি হয় না। মামলা হয়তো স্থবির হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তা চলতে থাকে। আমার মেয়ের হত্যা মামলাও বহুবার পর্যালোচনা হয়েছে, ডিএনএ পরীক্ষাসহ নিয়মিতই মামলার নানা যাচাই-বাছাই চলছে। প্রতিবারই মামলার এসব পর্যালোচনা আমাদের মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে, খুবই যাতনার মধ্যে ফেলে। আমাদের প্রচণ্ড রাগ হয়, কখনো কখনো গভীর মনঃকষ্টের মধ্যে পড়ে যাই আমরা। তোমার কী হয়? তুমি কী একদিন দরজায় কড়া নড়ে ওঠার শব্দের জন্য অপেক্ষা করো? একদিন পুলিশ সত্যিই তোমাকে খুঁজে পেয়ে গেলে তুমি কি ভয় পাবে, নাকি তুমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে?
সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে যতবার কোনো তরুণ-তরুণীর গুম হয়ে যাওয়ার খবর পাই, ততবারই আমরা আমাদের দুঃসহ স্মৃতিতে ফিরে যাই। ওই বসন্তকালের শুরুর দিকে তোমার কৃতকর্মের কারণে সারা জীবনের জন্য আমাদের জীবন পাল্টে গেছে। কিন্তু তোমার জীবন? তোমার জীবনের কী হয়েছে?
তোমাকে আমার বলা প্রয়োজন যে, প্রতিদিনই আমি কাঁদি আমার ওই মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এমন বেদনাদায়কভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে, ওর গর্ভে আমার যে নাতি-নাতনিরা কোনোদিনই জন্মাবে না ওদের দেখতে না পাওয়ার কারণে। আমি চিন্তায় থাকি যে আমার পরিবারটা আরও কত অন্য রকম হতে পারত। তুমি যে ভয়ানক অপরাধ করেছ, সে জন্য তোমার কীই-বা শাস্তি হতে পারে? যাবজ্জীবন কারাদণ্ড? একজন বিচারকই হয়তো তা ঠিক করে দেবেন, নয় বছর বা বারো বছরের কারাদণ্ড?
আর আমরা। ৩০ বছরেরও বেশি পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা পেয়ে যাচ্ছি।
সন্তানহারা এক মা