সুইসাইড নোটে যা লিখে গেল শাওন
নাজমুল হক শামীম : ফেনী সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের প্রবাসী দেলোয়ার হোসেনের ছেলে। আরাফাত শাওন (১৬)। উপজেলার সুন্দরপুর হাইস্কুল থেকে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে শাওন। গত ৩০শে মে পরীক্ষার ফলাফলে বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় শাওন। ফলাফল পেয়ে মিষ্টি কিনতে যেয়ে কিছুটা বিড়ম্বনার শিকার হয় সে।
আত্মীয়স্বজনের বকুনিও খেতে হয় তাকে। সেই থেকে অভিমান, অভিমান থেকে ওই দিন সন্ধ্যায় আত্মহত্যা। আত্মহত্যার তিনদিন পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার একটি ‘সুউসাইড নোট’ ছড়িয়ে পড়ে। সুইসাইড নোটে সে লিখে গেছে তার জীবন আর এ দেশের অভিশপ্ত শিক্ষাব্যবস্থার কথা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সুইসাইড নোটে আরাফাত শাওন যা লিখেছে তা হুবহু তুলে ধরা হলো- ‘আমি জানি না আজ আমি ঠিক কী ভুল কাজ করছি। তবে এখন এটা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আসলে ছেলে হয়ে এ পরিবারে জন্মগ্রহণ করাটাই আমার দুর্ভাগ্য। তা না হলে ছোট থেকে এ পর্যন্ত মেয়ের মতো সব সময় পরিবারের কাজ করতেই হয়েছে। আর কখনো পরিবার থেকে আমাকে খেলাধুলার সময় বা খেলতে দেয়া হয়নি। আর আমিও মেয়ের মতো সবসময় মায়ের আঁচলের নিচেই ছিলাম। আর আমি আদৌ জানি না যে আমি কি? এই পরিবারের বা আমার মা-বাবার সন্তান, তা না হলে সব সময় এ রকম শাসন আর কড়া শাসনের উপর আমাকে রাখা হয়েছে। কোন বাবা-মা তার সন্তানকে পড়ালেখার খরচে খোটা দেয় না। কিন্তু আমার মা-বাবা সব সময় আমাকে বলে তোর জন্য মাসে মাসে হাজার হাজার টাকা খরচ করছি। এভাবেই প্রতিনিয়ত বকাঝকা করা হয়। সব সময় বাবার থেকে শুধু খারাপ ভাষার গালি আর গালি শুনতে হয়। যা আমার একটুও ভালো লাগতো না।
কিন্তু আমি এতোদিন সহ্য করেছিলাম। কারণ কোন কিছু করার কথা ভাবলে মনে হতো এ দুনিয়ায় তো বাবা-মায়ের আদর ভালোবাসা পেলাম না। পেলাম না সুখ-শান্তি। আসলে টাকা পয়সা ও ধনসম্পদ মানুষকে সুখী করতে পারে না। আর যদি আমি নিজের হাতে আত্মহত্যা করি তা হলে মরার পরও শান্তি পাবো না। আর মরার পর আমাকে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। তাই এখন আমার আর এসব কিছু সহ্য হচ্ছে না...। আমাদের ছাত্রদের কি দোষ বলুন? আমরা তো আমাদের মতো চেষ্টা করে যাই। তবে আমাদের দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোর কারণে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এমন হাল। এর আগের বছর সরকার তার নিজের স্বার্থের জন্য শিক্ষার হার বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এবার হরতাল-অবরোধ দেয়ার ফলে বর্তমান সরকার বিরোধী দলকে গালি দেয়ার জন্য পাসের হার কমিয়ে দিয়েছে, যাতে দেশে ফেলের হার বেড়েছে। বলুন আমরা আর কিভাবে ভালো রেজাল্ট করতে পারি?
তবে, আমাদের মা-বাবা চায় আমরা ভালো রেজাল্ট করি। কিন্তু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকেও তো দেখতে হবে। আমার বাবা ও আমার আত্মীয়-স্বজন আমার এ রেজাল্ট (৪.৮৩) এর উপর খুশি না। সবাই আমাকে বকাবকি করছে। কিন্তু আমার স্কুলের মধ্যে ২য় স্থান পাওয়ার পরও কিন্তু তারা অন্যদের রেজাল্ট দেখে না, ভাবে না। তাদের কথা আমাকে এ+ পেতেই হবে। এ+ কী গাছে ধরে যে আমি পেড়ে আনবো। আরো অনেক কথা যা মনের ভেতর জমা করে রেখেছি। কিন্তু বললে শেষ হবে না। থাক। যদি আমি মারা যাই তা হলে সবাই আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আর যদিও বেঁচে যাই...!!! আমার কিছু ঋণ রয়েছে উঔ ঋষড়বিৎ ঞঁপয = সূর্য ৯০০, আমার বন্ধু শুভ= ১০০ (টাকা), ইসমাইল= ২০০/- পূবালী ইলেকট্র্রনিক শহীদ মার্কেট।
এ বিষয়ে নিহত শাওনের চাচা মো. নুর আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গত ৩০শে মে পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার পর মিষ্টি কিনতে শাওন তার খালতো ভাই রহিমের কাছে যায়। পরে রহিম থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড নিয়ে মিষ্টি কিনতে শহরের ‘সৌদিয়া মিষ্টি মহল’-এ যায়। নগদ টাকা ছাড়া মিষ্টি কিনতে ব্যর্থ হয়ে অভিমান করে বাসায় চলে যায়। ওই দিন সন্ধ্যায় বাসায় মাগরেবের নামাজ পড়ে শাওন পুকুরপাড়ে বসে বন্ধুদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছিলো। এসময় প্রবাস থেকে বাবার পাঠানো তেলাপোকা দমনের ঔষুধ খেয়ে ফেলে।
এক পর্যায়ে শাওনের মা পেয়ারা বেগম দ্রুত ঘটনাস্থলে যেয়ে শাওনকে পার্শ্ববর্তী সেনসিভ ক্লিনিকে নিয়ে যান। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে নেয়ার পথে রাত সাড়ে ৮টায় শাওন মারা যায়।
ফেনী মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জিয়াউল হক জানান, শাওনের মৃত্যুর খবর পেয়ে পুলিশ হাসপাতালে যায়। পরে পরিবারের অনুরোধে ময়নাতদন্ত ছাড়াই শাওনের লাশ নিয়ে যায় স্বজনরা। দেলোয়ার-পেয়ারা দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে শাওন ছিল সবার বড়। দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বড় সন্তান শাওনের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে বাবা-মা। ছেলের এমন করুণ মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না বাবা-মা। পাসের ফলাফলটি ছেলের মুখে শুনতে পারেনি বাবা। বাবা দেলোয়ার যখন প্রবাস থেকে ফোন করে ততক্ষণে ছেলে শাওন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
৫ জুন, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএএস/একে