বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০২২, ১১:২৯:০১

ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছেন সামিউল

ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছেন সামিউল

জহির হোসেন, ফরিদপুর: সন্তান থাকবে ইউরোপে, বাড়িতে প্রতি মাসে পাঠাবে দুই থেকে তিন লাখ টাকা, সংসারে আসবে সুখ- দালালদের এমন প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার দুই তরুণ। বেঁচে ফিরেছেন একজন, তার নাম সামিউল শেখ (২১)।

সামিউলের এই ফিরে আসাটা মোটেও সহজ ছিল না। এর জন্য তাকে অনেক শারীরিক নি'র্যা'তন ও কারাভো'গ করতে হয়েছে। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছেন তিনি। 

সামিউল শেখ ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাইচাইল ইউনিয়নের দক্ষিণ কাইচাইল গ্রামের ইউনুস শেখের ছেলে। তিনিসহ বেশ কয়েকজন স্পিডবোটে লিবিয়ার ত্রিপোলি হয়ে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে স্পিডবোটটি ডুবে যায়। তখন পানিতে ডুবে মারা যান সামিউলের অপর দুই বন্ধু বাবুর কাইচাইল গ্রামের বাসিন্দা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফারুক মাতুব্বরের ছেলে ফয়সাল মাতুব্বর (১৯) ও মাজেদ মিয়ার ছেলে নাজমুল মিয়া (২২)। 

গত ১০ মার্চ বাড়িতে ফিরে আসেন সামিউল। দুই বন্ধুকে হারিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা সামিউল তার বেঁচে ফেরার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। 

নৌকায় ওঠা, ডুবে যাওয়া ও বেঁচে ফেরার স্মৃতি

সামিউল শেখ বলেন, গত ২৭ জানুয়ারি লিবিয়ায় দালাল অলিদ আমাদেরকে শিপে উঠানোর জন্য লিবিয়ার জোয়ারা ঘাটে নিয়ে যায়। বলা হয়েছিল তিন তলা একটি শিপে উঠানো হবে, সঙ্গে থাকবে লাইফ জ্যাকেট, দেওয়া হবে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার। ঘাটে গিয়ে আমরা দেখতে পাই সেখানে মাঝারি আকারের একটি স্পিডবোট রাখা হয়েছে যেটির ধারণক্ষমতা ১৫ থেকে ২০ জন। কিন্তু সেখানে দুই চালকসহ মোট ৩৭ জনকে উঠানো হয়।

স্পিডবোটে উঠতে না চাইলে দালাল অলিদ আমাদেরকে ভয় দেখায় এবং পিস্তল তাক করে আমাদের বুকে ধরে। চার-পাঁচটা ফাঁকা গুলিও ছোড়ে। বাধ্য হয়ে বোটে উঠে বসি। আমাদের স্পিডবোট প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টা চলার পর ঝড়ো বাতাস শুরু হয়। তখন আমাদের অবস্থান ছিল মাল্টা জল সীমান্তে। তুমুল বেগে ঝড় শুরু হয়। আমাদের স্পিডবোট দোল খেতে থাকে। ঢেউয়ের পানিও উঠতে থাকে বোটের ভেতর। সাড়ে আট ঘণ্টা চলার পর মালটা জল সীমান্তে স্থানীয় সময়  ভোর সাড়ে ৪টার দিকে বোটটি উল্টে যায়।

ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে যান চালকসহ ২৯ জন। স্পিডবোটের অপর পাশে আমরা আটজন ধরে থাকি। পরে দেড় দুই ঘণ্টা পরে আমার বন্ধু নাজমুল মিয়া ঢেউয়ে বারি খেয়ে হারিয়ে যায়। এরপর আমরা সাতজন বোটের অপরপাশে ভাসতে ভাসতে তিউনেশিয়া সীমান্তে চলে যাই। আমাদের গায়ে তখন কোনো কাপড় ছিল না। এভাবে আমরা সাড়ে ১১ ঘণ্টা ভাসতে থাকি। 

আমাদের একজনের নাম ফারুক তার হাতে একটি লাল গেঞ্জি ছিল। আমরা দূর দিয়ে একটি শিপ যেতে দেখে লাল গেঞ্জি দেখিয়ে হাত উঁচু করলে তারা দূরবীন দিয়ে আমাদের দেখতে পায়। তারা ছিল লিবিয়ার কোস্টগার্ড। আমাদের বিপদগ্রস্ত দেখে তারা তিউনেশিয়া সীমান্ত থেকেই উদ্ধার করে শিপে উঠায়। তখন আমরা আমাদের স্পিডবোটের দুই আরোহীর মরদেহ ভাসতে দেখি। তবে আমরা বললেও সেগুলো শিপে উঠায়নি কোস্টগার্ড। পরে তারা আমাদের ওই শিপের মধ্যেই বুট জুতা দিয়ে লাথি মারতে থাকে। আমাদের অপরাধ আমরা অনিয়ম করে অবৈধ পথে বিদেশ যাচ্ছি। 
শিপে উঠে মারা যায় আমাদের আরেক সহযাত্রী রাশেদুল। তার দাফন হয় লিবিয়ায়।

তখন মিশরের দুই চালকসহ মোট ৩৭ জন নাবিকের মধ্যে ছয়জন বেঁচে ফেরেন। যে ছয়জন বেঁচে ফিরেছেন তারা হলেন, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার হাসনাবাদ গ্রামের ইউসুফ মৃধা, নরসিংদীর নালিখা গ্রামের ইয়াসিন, নরসিংদীর বেলাব থানার ফারুক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাকির, মাদারীপুরের ইউনুস ও নগরকান্দার সামিউল শেখ।

কোস্টগার্ডের নির্যাতন ও লিবিয়া জেলের ভ'য়াল স্মৃতি

সামিউল বলেন, শিপে অবস্থানকালে আমাদের শারীরিক অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। কারণ,  আমরা সাড়ে ১১ ঘণ্টা কিছু না খেয়েই সমুদ্রে ভাসছিলাম। পুলিশের কাছে খাবার চাইলে আমাদের খাবার দেওয়া হতো সামান্য এক টুকরা রুটি আর পানি। সেদিন (২৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় আমাদের ছয়জনকে লিবিয়ার জাউইয়া ঘাটে এনে নামানো হয়। পরে নিয়ে যাওয়া হয় জাউইয়া জেলে।

সেখানে থাকতে হয় ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। পরে নিয়ে যাওয়া হয় খামছাখামছিন জেলে। সেই জেলে লিবিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি কর্মী ও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে আটক ৩০০ জনের বেশি বাংলাদেশি রয়েছে। সেখানে ১ মাস ২৮ দিন থাকতে হয়। জেলে আটক অবস্থায় লিবিয়ার স্থানীয় খাবার আনুমানিক ১০০ গ্রাম পরিমাণের খুবজু (রুটি) বেলা ১১টায় দেওয়া হতো এবং রাত ১১টায় একই পরিমাণ খুবজু দেওয়া হতো। জেলে আটক অবস্থার ১ মাস ২৮ দিনের মধ্যে প্রতিদিন পানির বোতলের ছিপি মেপে ২ থেকে ৩ ছিপি পরিমাণ পানি খেতে দেওয়া হতো সকাল ও রাতে। পিপাসায় আমাদের গলা শুকিয়ে আসলেও পানি দেওয়া হতো না। আমাদের ওপর শারীরিক নির্যাতনও করা হত। 

দেশে ফেরা যেভাবে

সামিউলের বর্ণনা অনুযায়ী,  ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) থেকে যোগাযোগ করে আমাদের সঙ্গে। পরে আইওএম আমাদের দেশে ফিরে আসার ব্যয়ভার বহন করে এবং ঢাকা বিমানবন্দরে আসার পর প্রত্যেককে চার হাজার ৭৮০ টাকা দেওয়া হয় বাড়িতে যাওয়ার জন্য। ২ মার্চ ঢাকা ফিরে আসি। সাত দিন বিমানবন্দরের পাশে হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইন শেষ করে ১০ মার্চ বাড়ি ফিরে আসি।

দালাল চক্রের যে কথায় ফাঁ'দে পড়েন তারা

সামিউল শেখের বাবা ইউনুস শেখ জানান, মানবপাচার চক্রের দুই সদস্য থাকেন লিবিয়ায়, দুজন থাকেন দেশে। লিবিয়ায় আছেন কাইচাইল ইউনিয়নের ছোট নাওডুবি গ্রামের মৃত শামছুদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে শওকত মাতুব্বর (২৫) ও চানু মাতুব্বরের ছেলে রাসেল মাতুব্বর (৩৫)। দেশে থাকা তাদের দুই সহযোগী হলেন নাওডুবি গ্রামের হান্নান মাতুব্বরের ছেলে শাহিন মাতুব্বর (৪১) ও মৃত শামসুদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে ইলিয়াস মাতুব্বর (৩৯)।

ইউনুস শেখ বলেন,  আমি যখন কৃষি জমিতে কাজ করতাম তখন এই দালাল চক্রের সদস্য শাহীন ও ইলিয়াস আমার কাছে কাছে ঘেঁষতেন। বিদেশের নানা সুবিধার কথা বলে লোভ দেখাতেন।
বলতেন, ‘তোমার তো অনেক বয়স হয়ে গেছে আর কত দিন কষ্ট করবা। ছেলে তো যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে। ওকে বিদেশে পাঠিয়ে দাও। আমার ভাইয়েরা বিদেশে থাকে। ভালো ভিসা আছে। ব্যবস্থা কইরা দিবানে। প্রতি মাসে দুই থেকে তিন লাখ টাকা বেতন পাবে। তেমন কষ্টের কাজ না।’

প্রথমদিকে দালালদের এসব কথায় পাত্তা দিতাম না। কিন্তু বার বার ওই লোভনীয় প্রস্তাবের পাশাপাশি ওই দালালদের আত্মীয় ও আমাদের ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার ফারুকের প্রতিশ্রুতিতে আমি রাজি হই। ফারুক বলতেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। আমার নিজের ছেলেও তো যাচ্ছে।’ তাছাড়া লিবিয়ায় যারা আছে তারা আমারই আত্মীয়। ভয় নেই।

একসঙ্গে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিন বন্ধু

২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকায় যান সামিউল, ফয়সাল ও নাজমুল। ঢাকার কাকরাইল এলাকার আল হেলাল বোর্ডিংয়ে তিন দিন থাকেন তারা। সেখান থেকে ১৭ নভেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে দুবাইয়ে দালাল শওকতের ভাই জুয়েল মাতুব্বরের কাছে পৌঁছান ১৮ নভেম্বর। জুয়েলের কাছে ওই তিনজন ১২ দিন থেকে ১ ডিসেম্বর বিমানে লিবিয়ায় যান। 

লিবিয়ায় অবস্থানকালে দুই মাস যেমন কেটেছে

লিবিয়া প্রায় দুই মাস তাদের থাকতে হয় বদ্ধ একটি ঘরে। দালালচক্র তাদেরকে ভয় দেখিয়ে বলতো বাইরে যুদ্ধ হচ্ছে এবং তাদের মালিকের সাতটি পিস্তল আছে বের হলে গুলি খাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তোমাদের রুমের মধ্যেই থাকতে হবে।

সামিউল বলেন, তিন বন্ধুসহ ছোট্ট একটি বদ্ধ রুমে এভাবেই প্রায় দুই মাস এক প্রকার বন্দী ছিলাম ২০ জন। সেখানে আমাদের খাবার খাবার দেওয়া হতো তিন বেলা । মাঝে মাঝে কয়েকদিন সামান্য পরিমাণে দেওয়া হতো। সেখানে স্থানীয় খাবার রুটির মতো খুবজু দেওয়া হতো সকালে ও দুপুরে । রাতে কখনো কখনো সামান্য পরিমাণ ভাত দেওয়া হতো। দালাল রাসেল মাতুব্বর ও শওকত মাতুব্বর লিবিয়ায় অবস্থানরত নরসিংদীর দালাল মনির শীলের কাছে বিক্রি করে দেয় আমাদের। পরে মনির শীল আমাদের লিবিয়ার দালাল অলিদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, দেশের দুই দালাল দুই দফায় নাজমুল ও সামিউলের বাড়ি থেকে সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা ও ফয়সালের বাড়ি থেকে সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা নেন।

নাজমুলের মা রেখা বেগম হৃদরোগে আক্রান্ত। ছেলের নির্মম মৃত্যুর খবরে তিনি আরও ভেঙে পড়েছেন। কথা বলতে গেলে গলায় আটকে যায়। ছেলে হারিয়ে রেখা বেগম বলেন, ‘আমার কিছুই বলার নাই। আমার জাদুরে যারা পানিতে ডুবাই মারল, আমি তাদের বিচার চাই। সরকারের কাছে দাবি জানাই তাদেরকে গ্রেপ্তার করে এমন বিচার করা হোক যাতে কোনো মাকে তার সন্তানের এমন নির্মম মৃত্যুর খবর না শুনতে হয়।’

এদিকে এ ঘটনায় ফয়সালের বাবা ফারুক মাতুব্বর বাদী হয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ১০ জনকে আসামি করে মানবপা'চার আইনে  নগরকান্দা থানায় মামলা করেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগরকান্দা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) পীযূষ কান্তি দে বলেন, পুলিশ এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হান্নান মাতুব্বর ও তার ছেলে তুহিন মাতুব্বর এবং সান্দেহভাজন আসামি হিসেবে কাজল মাতুব্বরকে গ্রেপ্তার করেছে। বেঁচে ফেরা সামিউল শেখ গত সোমবার (১৪ মার্চ) আদালতে জবানব'ন্দি দিয়েছেন। সূত্র: ঢাকা পোস্ট

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে

aditimistry hot pornblogdir sunny leone ki blue film
indian nude videos hardcore-sex-videos s
sexy sunny farmhub hot and sexy movie
sword world rpg okhentai oh komarino
thick milf chaturb cum memes