রুদ্র মিজান : কথা ছিল মা-বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে ঈদ করবেন। সেরকম স্বপ্ন নিয়েই বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন দুই বোন তাহমিনা ও রুজিনা। দরিদ্র পরিবারের দুই তরুণী সঙ্গে নিয়েছিলেন চাল, চিনি, তেল। ঢাকার গাজীপুর থেকে হবিগঞ্জের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে সকালে বাসা থেকে বের হন তারা।
গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীর ট্যাম্পাকো কারখানার পাশ দিয়ে রিকশায় করে যাচ্ছিলেন। পরনে ছিল নতুন জামা। হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন দুই বোন। তারা কি জানতেন এটাই ছিল তাদের জীবনের শেষ হাসি। শেষ মুহূর্ত। আশেপাশের লোকজন দেখেছেন সেই ভয়াবহ দৃশ্য। একটা বিকট শব্দ।
প্রত্যক্ষদর্শী শামীম বলছিলেন, যেন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারদিকে আগুনের শিখা আর ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছিল আশপাশে। দেয়াল ধসে পড়ছিল। এসময় দৌড়ে টঙ্গী বাসস্ট্যান্ডের দিকে চলে যান শামীম। তাহমিনা-রুজিনা কী হয়েছিল শামীম জেনেছেন আরও পড়ে। ধসে পড়া দেয়ালের চাপাতেই মারা যান দুই বোন তাহমিনা, রুজিনা ও রিকশাচালক।
পাকিজা গ্রুপের ফ্যাক্টরির ম্যানেজার মারুফ বিল্লাহ জানান, দুই বছর ধরে পাকিজা গ্রুপের ফ্যাক্টরিতে কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকরি করতেন তাহমিনা। শুক্রবার সন্ধ্যায় ফ্যাক্টরিতে কর্মরতদের ঈদের উপহার হিসেবে চাল, চিনি ও তেলের একটি প্যাকেজ দেয়া হয়। শনিবার সকালে ওই উপহার নিয়েই বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন তাহমিনা ও রুজিনা। পাকিজার পাশের একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন রুজিনা। দুই বোন থাকতেন টঙ্গী শিল্প নগরীতেই।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় যখন একের পর এক এম্বুলেন্স ঢুকে। তখন নিহতদের স্বজনদের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। ১০টি এম্বুলেন্সে করে সেখানে পাঠানো হয় ১৯ লাশ। এম্বুলেন্সের সামনে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছিলেন তাহমিনার তিন ভাই। ‘কই গেলেরে বইন, কই গেলে, আল্লাহ আমার বোনরে কই লইয়া গেলেন।’ দুই সন্তানের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন দিশেহারা পিতা হানিফ মিয়া। চোখ দিয়ে জল পড়ছিল।
হানিফ মিয়া জানান, অভাবে সংসারে একটু সুখের জন্য দুই মেয়ে টঙ্গীতে কাজ করতো। সাত বছর ধরেই তারা বিভিন্ন কারখানায় কাজ করেন। কথা ছিল সবাই এক সঙ্গে ঈদ করবেন। বাড়িতে সবাই অপেক্ষায় ছিলেন তাহমিনা ও রুজিনার জন্য। হানিফ মিয়া বলেন, ‘আমি এক অভাগা বাপ। আমার আগে আমার দুই মেয়েরে আল্লাহ নিয়া গেছউন’। হানিফ মিয়া জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার গণশ্যামপুর গ্রামে।
টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীর ট্যাম্পাকোর স্টোর রুমের শ্রমিক ছিলেন সোলেমান। সময় মেনে চলতেন তিনি। ঘটনার দিন গতকাল শনিবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ট্যাম্পাকোর পাশেই একটা ছোট্ট ঘরে স্ত্রী, সন্তান ও শ্বাশুড়িকে নিয়ে থাকতেন তিনি। ভোরে খাবার রান্না করে বক্সে ভরে দেন শ্বাশুড়ি। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে বারবার তাড়া দিচ্ছিলেন। স্ত্রী নাসিমাকে বলছিলেন, এক মিনিট পরে গেলেই সমস্যা হবে। কার্ড পাঞ্জ করতে হয়। সেখানে সময় উঠে। দেরি করে গেলে বসেরা রাগ করবেন। সোলেমানের স্ত্রী নাসিমা জানান, বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আগুন, আগুন চিৎকার শুনতে পান।
প্রতিবেশী শেলী জানান, সোলেমান যেখানে কাজ করেন সেখানেই আগুন লাগছে। সঙ্গে সঙ্গে আড়াই বছরের মেয়েকে নিয়ে বের হয়ে যান নাসিমা। কিন্তু আগুনের জন্য কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তখন পর্যন্ত অনেককে উদ্ধার করেছেন আশপাশের লোকজন। নামিসা ছুটে যান টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে। তরপর ঢাকা মেডিকেল। বিকালে খোঁজ পান স্বামীর লাশের। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে নাসিমা জানান, ঘটনার সময় কারখানার দ্বিতীয় তলায় ছিলেন সোলেমান। সেখানে কোনো সিঁড়ি নেই।
লিফটে মালামাল নামানো-উঠানোর কাজ করতেন তিনি। ঘটনার সময় সেই কাজই করছিলেন। কাজ করতে করতেই মানুষটি চলে গেলো, বলে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন নাসিমা। জানালেন, তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর থানার আনহা গ্রামে। দুই সন্তান ১১ বছর বয়সী নাসির ও আড়াই বছর বয়সী লামিয়ায়ে নিয়ে গাজীপুরের টঙ্গীতে থাকতেন তারা। ছয় বছর ধরে ওই কারখানায় কাজ করতেন সোলেমান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অন্ধকার দেখছেন নাসিমা।
টঙ্গী থেকে বেলা ২টায় এম্বুলেন্সযোগে ছয়টি লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢামেক’র মর্গে। বিকাল ৫টায় নিয়ে যাওয়া হয় আরও ১৩টি লাশ। তার আগে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন তাহমিনাসহ পাঁচজনকে।
অন্যরা হচ্ছেন, ঢাকার উত্তরখান থানার মুন্ডার ওয়াহিদ মিয়ার পূত্র ওয়াহিদুজ্জামান স্বপন, দক্ষিণ বাড্ডার জিপি-ক ৮১ নম্বর বাড়ির ওয়াজেদ আলীর পুত্র আনোয়ার হোসেন, ওই কারখানার সিকিউরিটি ইনচার্জ শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী থানার পুড়াঘর গ্রামের আবদুল খালেকের পুত্র দেলোয়ার হোসেন ও ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার প্যারাডাঙ্গা গ্রামের রণি মিয়ার পুত্র আশিক।
এছাড়া বিস্ফোরণে দগ্ধ-আহত ১৪ জনকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন, শাহীন আকমল, রোকন, কামরুল, প্রাণকৃষ্ণ, জাকির হোসেন, রাসেল, আনোয়ার হোসেন, রিপন দাশ, মনোয়ার হোসেন, ফেরদৌস, নিজু, ইমরান, শিপন ও অজ্ঞাত পঞ্চাশ বছর বয়সী এক পুরুষ। তাদের মধ্যে রিপন দাশের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানান। তার শরীরের ৯৯ ভাগ দগ্ধ হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শঙ্কর পাল জানান, বার্ন ইউনিটে পাঁচজন চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। একমাত্র রিপন দাশ ভর্তি রয়েছেন। অন্যরা ধোয়াসহ বিভিন্ন কারণে আহত হয়েছেন। তাদের মেডিকেলের অন্যান্য বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। এমজমিন
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি