রায়হানুল ইসলাম আকন্দ : এলাকার সবাই খাইরুল ইসলামকে (২৬) সহজ-সরল সাধারণ ছেলে হিসেবেই চিনতো। জঙ্গি সংগঠনে তার কোনও সম্পৃক্তা থাকার কথাও কেউ বলতে পারেননি। সেই খাইরুলকেই শুক্রবার গাজীপুর সদর থেকে হুজির সদস্য হিসেবে আটক করেছে পুলিশ। তবে খাইরুলের পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পুলিশ বলেছে জয়দেবপুরের একটি কটেজ থেকে ধরেছে।
খায়রুলের বাড়ি গাজীপুরের মধ্য কাউলতিয়ায়। তার বাবা আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার ছেলেকে ২০১৪ সালের কোনও একদিন সাদা পোশাকে পুলিশ বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তখন পুলিশের কাছে ধর্ণা দিয়েও ছেলের হদিস পাইনি। টানা ৪৮ দিন পর পুলিশ কিছু বইপত্র সাজিয়ে এবং খাইরুলকে হরকাতুল জিহাদের সদস্য অভিযোগে ঢাকার সিএমএম আদালতে তোলে।’
তিনি বলেন, সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) রাত ১টার দিকে ডিবি পুলিশের লোকজন বাড়িতে ঢুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খাইরুলকে নিয়ে যায়। পরেরদিন ২৮ অক্টোবর (শুক্রবার) পুলিশ বলেছে, জয়দেবপুর থানার নান্দুয়াইন এলাকার গভীর বনে সুফিয়া কটেজের পরিত্যক্ত একটি একতলা বিল্ডিং থেকে ২০ অক্টোবর রাতে খাইরুলকে গ্রেফতার করেছে। তার কাছ থেকে পেট্রোল বোমা ও বিস্ফোরক দ্রব্য পেয়েছে।
খাইরুলের প্রতিবেশী ওমেজ উদ্দিন বলেন, ‘পুলিশ ধইরা নিছে বাড়ি থেইক্যা। আর সাংবাদিকগোর কাছে বলছে কটেজ থেইক্যা ধরছে। বিষয়টা দুইরকম হইয়া গেল।’
স্থানীয় সানোয়ার বলেন, তার দুই ব্যাচ জুনিয়র ছিল খাইরুল। খাইরুল জঙ্গি কাজে জড়িত কিনা জানা নেই তার। পুলিশ তাকে গ্রেফতারের পর পত্রিকায় খবর শুনেছেন। তবে পুলিশ তাকে গ্রেফতারের স্থান এবং যে তারিখ উল্লেখ করেছে তা ঠিক নয়।
কাউলতিয়া বাজারের টেইলার মাস্টার বাবুল হোসেন বলেন, ‘খাইরুলের ব্যাপারে এলাকায় কোনও খারাপ রিপোর্ট নেই। এলাকার সব লোকেই বলবে সে ভালো ছেলে। সে এলাকায় প্রাইভেট পড়িয়েছে। যারা তার কাছে পড়েছে তারা পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছে। রফিজের ছেলে আল আমীনসহ অনেকেই তার কাছে পড়ে এসএসসি পাশ করতে সক্ষম হয়েছে। খাইরুল কিছুদিন আগে সাভারের জিরানী এলাকায় মাস দুয়েক চাকরি করেছে। এরপর আবার বাড়িতে এসে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেছে। তাকে পুলিশ শুক্রবার রাতে বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে, অথচ শনিবার পত্রিকায় দেখলাম কটেজ থেকে ধরে নিয়ে গেছে। ঘটনা মিথ্যা।’
গাজীপুর মহানগরের ২১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এস এম ফারুক বলেন, ‘খাইরুল জঙ্গি কিনা আমার জানা নেই। তবে খারাপ ছেলে হিসেবে এলাকায় তার বদনাম নেই।’
খাইরুলের চাচাতো বোন শারমীন বলেন, ‘বছর চারেক আগে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার ফুলহারা গ্রামের আব্দুল করিমের মেয়েকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করে খাইরুল। গত রোজার ঈদের পর সে দুমাস সাভারের জিরাবোতে একটি নির্মাণাধীন কোম্পানিতে চাকরি করত। কোম্পানির উৎপাদন শুরু না হওয়ায় দু’মাসের বেতন নিয়ে সে বাড়ি ফিরে আবার প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেছে।’
খাইরুলের চাচী আনোয়ারা বলেন, ২০১৪ সালে তাকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার ল্যাপটপ নিয়ে গেছে। সেটাও ফেরত দেয়নি। গত শনিবারও তার ল্যাপটপ এবং দুটি মোবাইল নিয়ে গেছে।
খাইরুলের মা খোরশেদা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে অন্য সব মানুষের মতো বাঁচতে চাওয়ার আঁকুতি জানিয়েছে। সে আমাকে বলেছে, দেশের ১৭ কোটি মানুষ খারাপ কাজ করতে বললেও সে খারাপ কাজ করবে না। ডিবি পুলিশ প্রথমে আমাকে ও আমার স্বামীকে ডেকে তুলে। পরে খাইরুলের ঘরে গিয়ে তাকে ডেকে তুলে নিয়ে যায়। কী কারণে তাকে নিয়ে যাচ্ছে তাও তারা বলেনি। আল্লাহ এমন ব্যাভিচার সহ্য করবেন না।’
খাইরুলের বাবা আবুল কাশেম কাউলতিয়া জহির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। খাইরুল ওই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে টাঙ্গাইলের পলিটেকনিক ইন্সটিউটে পড়াশোনা শেষে গাজীপুরের আইআইউটিতে ভর্তি হয়।
২৮ অক্টোবর দুপুরে গাজীপুর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, জয়দেবপুর থানার নান্দুয়াইন এলাকার গভীর বনে সুফিয়া কটেজের পরিত্যক্ত একটি একতলা ভবনে জঙ্গিরা অবস্থান করছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা জানতে পারে, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সেখানে শলাপরামর্শ করছিল। সেখানে অভিযান চালিয়ে তারা খাইরুল ইসলাম (২৬), টাঙ্গাইলেল আমিনুল হক (৪৯), একই জেলার শহীদ উল্লাহ (৪৩) ও ময়মনসিংহের গোলাম কিবরিয়া খান (২৫) কে আটক করে।
এসপি বলেন, ‘এদের মধ্যে খাইরুল ইসলাম ও গোলাম কিবরিয়া গাজীপুরের ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’র (আইইউটি) সাবেক শিক্ষার্থী এবং শহীদ উল্লাহ আরাকান ফেরত জঙ্গি।’
ঘটনাস্থল থেকে দুটি ছোরা, একটি চাপাতি, ৪টি ককটেল, কয়েকটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, ১৪টি পেট্রোল বোমা ও বিভিন্ন জিহাদি বই উদ্ধার করেছে পুলিশ।
গাজীপুর ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমির হোসেন জানান, খাইরুলসহ অন্য চারজনকে শনিবার (২৯ অক্টোবর) আদালতে হাজির করা হয়। তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। -বাংলা ট্রিবিউন।
৩০ অক্টোবর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম