অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন: মফস্বল সংবাদ পত্রের জগতে সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা বহুল পরিচিত একটি নাম। বহমান শীতলক্ষ্যা নদী বিধৌত প্রাচীণ জনপদ গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে আশির দশকের শেষ দিকে ‘সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা’ নামে যে পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল আজ তা ২৭ বছর পেরিয়ে ২৮ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে।
২৭ বছর কোনো সোজা কথা নয়। শৈশব, কৈশর পেরিয়ে শীতলক্ষ্যা আজ ভরা বর্ষায় তারুণ্যদীপ্ত যৌবনে ভরপুর। মানুষের কাছে শীতলক্ষ্যা যেমন খুবই প্রিয় একটি নাম, ঠিক তেমনি পাঠকের কাছে সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা বস্তুনিষ্ঠতায় সমুজ্জল।
শুষ্ক মৌসুমে শীতলক্ষ্যা নদী যেমন মাঝে মাঝে নাব্যতা হারিয়ে গতিপথে বাঁধার সম্মুখীন হয়, আবার বর্ষনে ফিরে পায় নদীর স্বাভাবিক স্রোতধারা। অর্থনৈতিক সমস্যা, নানা প্রতিকূলতা শীতলক্ষ্যার নিয়মিত প্রকাশকে কখনো কখনো বাধাগ্রস্থ করলেও অগনিত পাঠকের ভালোবাসায় আবার সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা প্রকাশিত হয়েছে আপন মহিমায়।
সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা বস্তুনিষ্ঠার সাথে তার সাংবাদিক দায়িত্ব এবং সাথে সাথে নিজ সমাজ ও সভ্যতার প্রতি সাহসী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ২৭ বছর পূর্বে কাপাসিয়ার মতো একটি পল্লী অঞ্চল থেকে পত্রিকা প্রকাশ চাট্টিখানি কথা নয়। টিকে থাকার জন্যে প্রায় তিন দশক ধরে পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক শেখ তমিজ উদ্দিন আহম্মদ খোকাকে কঠোর পরিশ্রম, সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।
কাপাসিয়া তথা গাজীপুরবাসির সহযোগিতা ও ভালোবাসা না থাকলে টিকে থাকার লড়াইয়ে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করা আদৌ সম্ভব ছিলো না। শীতলক্ষ্যা একটি সাহসী, সত্যবাদী এবং এতদ অঞ্চলের আপামর জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত পত্রিকা।
সন্দেহ নেই, পাঠক সমাজের মধ্যে তার নিরপেক্ষতা এবং দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে চলেছে। সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যার ২৭ বর্ষ পূর্তিতে সম্পাদক, সকল সংবাদকর্মী, পাঠক, শুভানুধ্যায়ীদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। ২৭ বছর পূর্বে পত্রিকা প্রকাশের পিছনে যারা নিরলসভাবে কাজ করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যার প্রতিষ্ঠাকালিন সম্পাদক সর্বজন শ্রদ্ধেয় মো. আইয়ুবুর রহমান খান পত্রিকা প্রকাশের জন্যে যে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন শীতলক্ষ্যা পরিবার তা আজীবন স্মরণ রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি তখন কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজের ছাত্র। মনোরম সিনেমা হলের পশ্চিম পার্শ্বে মরহুম সাত্তার চেয়ারম্যান এর মার্কেটে ছিলো শীতলক্ষ্যা পত্রিকার নতুন অফিস।
১৯৮৯ সালের ১১ ডিসেম্বর কাপাসিয়া উপজেলা পরিষদ হলরুমে সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা পত্রিকার বহুল প্রত্যাশিত প্রথম প্রকাশনা উৎসবে আমারও উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। ছাত্র জীবন থেকেই লেখা লেখির প্রতি আমার আগ্রহ ছিলো। প্রয়াত সাংবাদিক বদরুদ্দীন হায়দার ছিলো আমার অনুপ্রেরণা। যতটুকু মনে পড়ে সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা পত্রিকার আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক এমপি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
প্রধান অতিথি ছিলেন, বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের তৎকালিন চেয়ারম্যান ও দৈনিক জনতার সম্পাদক দেশ বরেণ্য সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী। অতিথি ছিলেন, তৎকালিন কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদ নেওয়াজ, কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক সাহিত্যনিধি সৈয়দ এহছানউদ্দীন আহমদ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আলী হোসেন, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের জনপ্রিয় অধ্যাপক আমার প্রিয় স্যার রফিজ উদ্দীন মোল্লা, কাপাসিয়া উপজেলা আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেট মমিনুল ইসলাম, কাপাসিয়া থানার ওসি বদরুদ্দোজা, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি গাজীপুর জেলার সভাপতি দৈনিক সংবাদের সাংবাদিক তারাগঞ্জে বদরুদ্দীন হায়দার, কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মোল্লা মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীনসহ কাপাসিয়ায় কর্মরত বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক, শিক্ষক, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ শীতলক্ষ্যার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
তাদের অনেকেই আজ আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। কিন্তু তাদের সেই উপস্থিতি শীতলক্ষ্যা পরিবারের অনুপ্রেরণার উৎস ও পাথেয় হয়ে থাকবে। তখন কাপাসিয়ায় বিভিন্ন পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিকের সংখ্যা ছিলো হাতে গোনা। এত পত্রিকাও ছিলো না। ছিলো না এতো বেশি সাংবাদিক।
বর্তমানে দেশে অনেক দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক পত্রিকা বের হয়েছে। সব পত্রিকার নামও মনে থাকে না। সাংবাদিক হয়েছে ডজন ডজন। বর্তমানে সাংবাদিকতার মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
আমার জানামতে কাপাসিয়া সাংবাদিকতার বীজ বপনকারী হাতে গোনা সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শেখ তমিজ উদ্দিন আহম্মদ খোকা, মরহুম বদরুদ্দীন হায়দার, মরহুম অধ্যাপক সৈয়দ একরাম হোসেন, অধ্যাপক ফ.ম. এমদাদুল হক, সঞ্জীব কুমার দাস, বিল্লাল হোসেন বাচ্চু, সাইফুল ইসলাম শাহীন, অধ্যক্ষ মাও. আব্দুর রহমান, মুসলেহউদ্দীন আহম্মদ, জাকির হোসেন কামাল, শারফুদ্দীন সবুজ।
তাদের কর্ম প্রেরণায় পরবর্তীতে আমিসহ অনেককেই সাংবাদিকতার নেশায় পেয়েছিল। লেখার কলেবর বেড়ে যাওয়ায় সকলের নাম লিখা সম্ভব হচ্ছে না। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা পত্রিকার প্রকাশকালীন সময়ে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন আমার বন্ধুবর সাংবাদিক এফ এম কামাল হোসেন। পত্রিকা ছাপানোর জন্যে শেখ তমিজ উদ্দিন আহম্মদ খোকা ভাই কামালকে ঢাকায় পাঠাতেন। আইয়ুবুর রহমান খানের সাথে পত্রিকা নিয়ে পরামর্শ করতেন।
সাপ্তাহিশ শীতলক্ষ্যা পত্রিকা প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসে সানাউল্লাহ নূরী কামালদের বাসায় দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন। কামাল এর বড়বোন রীনা আপা সানাউল্লাহ নূরীর জন্যে সেদিন মুখরোচক খাবারও রেধে ছিলেন। এসব শুধু স্মৃতি নয়, আজ সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা পত্রিকার ২৭ বছরের ইতিহাসের সোনালী অধ্যায় হয়ে থাকবে।
সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা শুধু সংবাদই প্রকাশ করেনি। শীতলক্ষ্যা কাপাসিয়ায় অনেক সাংবাদিক তৈরীতে নিরলস ভূমিকা রেখেছে। সাপ্তাহিক গাজীপুর দর্পণের সম্পাদক শেখ মঞ্জুর হোসেন মিলন, সাপ্তাহিক বাংলাভূমির সম্পাদক সজরুল ইসলাম আজহারের সাংবাদিকতা শুরু হয়েছিল সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যার মাধ্যমে। খোকা ভাইয়ের বড় ছেলে শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ বর্তমানে বাংলাদেশ প্রতিদিনের স্টাফ রিপোর্টার। শীতলক্ষ্যা ছিলো তার হাতে খড়ি।
অর্থনৈতিক কারণে সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা মাঝখানে একবার নিয়মিত প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খোকা ভাই আমাদেরকে ডেকে বললেন, তোমরা সহযোগিতা না করলে আমি আর পারছিনা। আমি নজরুল ইসলাম আজহার, নজরুল ইসলাম মাস্টার, আমেরিকা প্রবাসী উত্তম কুমার সাহা নিজেদের অর্থ দিয়ে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে মাসিক নিয়মিত গ্রাহক তৈরী করে আবার সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা পুন:প্রকাশের একটি সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
খোকা ভাই আজও আমাদের সেই ভূমিকা মনে রেখেছে। পরবর্তীতে নূরুল আমিন শিকদার, বেলায়েত হোসেন শামীমও শীতলক্ষ্যার সাথে জড়িত হয়েছিলেন। মোট কথা কাপাসিয়ার সাংবাদিক সমাজ সব সময়ই শীতলক্ষ্যার দু:সময়ে খোকা ভাইয়ের পাশে এসে দাড়িয়েছে।
সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা ২৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। শীতলক্ষ্যা পত্রিকা অফিসের সামনে বিশাল মনোরম গেইট নির্মাণ করা হয়েছে। আলোক সজ্জা ও নানা বর্ণের ব্যানার ফ্যাস্টুনে সাজানো হয়েছে কাপাসিয়া শহরস্থ পত্রিকা অফিসকে। কাপাসিয়া উপজেলা অডিটরিয়ামে ২৭ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, স্থানীয় এমপি বঙ্গতাজ কন্যা সিমিন হোসেন রিমি। প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শাবান মাহমুদ।
শীতলক্ষ্যার ২৭ বছর পূর্তিতে শতাধিক পুথী সম্বলিত ৪ রঙের ম্যাগাজিন আকারে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হবে।
কাপাসিয়ার মুক্তিযুদ্ধ, কাপাসিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে সাংবাদিক গুনীদের লেখায় সমৃদ্ধ থাকবে ম্যাগাসাইজের ম্যাগাজিনে। এই ম্যাগাজিন হবে সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যার পক্ষ থেকে কাপাসিয়া উপজেলার একটি বিশেষ স্মারক। ২৭ বছর পূর্তিতে প্রতিদিনই সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যার সম্পাদককে বিভিন্ন শ্রেণি প্রেশার মানুষ ও সংগঠক নানা উপহার ও ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে পত্রিকা অফিসে আসছেন। ২৭ বর্ষে পাঠকের ভালোবাসায় সিক্ত সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা।
সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা পত্রিকার সম্পাদক ও তার সাংবাদিকদের কাছে কাপাসিয়া তথা গাজীপুরবাসীর প্রত্যাশাও অনেক। বর্তমান যুগ মিডিয়ার যুগ। যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে মিডিয়া। আমরা হয়ে উঠেছি মিডিয়া নির্ভর। সংবাদপত্র সমাজে আয়না। পত্রিকার মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্র সঠিকভাবে ফুটে উঠে। আমাদের এই সভ্য জগতে মিডিয়ার চেয়ে বড় শক্তি আর নেই।
প্রতিদিন সকাল বেলায় সংবাদপত্রটি হাতে না এলে পাঠকের দিনের শুভ সূচনা হয়না। একটা অপূর্ণতার তৃপ্তি যেন অনুভূত হয়। দিনের শুরুতে একটি টাটকা সংবাদপত্র হাতে নিয়ে অনেক পাঠকই পড়তে বসেন চায়ের টেবিলে। পাঠক চায়ের কাপে চুমু দেন আর তরতাজা মুদ্রিত ভাঁজ করা সংবাদপত্রের শিরোনামগুলো পড়ে ফেলেন একের পর এক।
খুঁটি নাটি অনেক কিছুই মানুষ জানতে চায়। অনেক সময় স্থানীয় কোন ঘটনা সম্পর্কে পাঠক বিস্তারিত জানার আগ্রহ থাকে। মফস্বলের পত্রিকা হিসেবে সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা পাঠকের সকল জানার আগ্রহ ও কৌতুহল পূরন করবে সেই প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক। শীতলক্ষ্যা হবে কাপাসিয়া, গাজীপুরের প্রতিচ্ছবি। মফস্বল সাংবাদিকতার বিকাশে শীতলক্ষ্যা আরো বেশি ভূমিকা পালন করবে।
সাংবাদিকতার নীতিমালাকে পাথেয় করে সত্য প্রকাশে হবে নির্ভিক। মানুষের দু:সময়ে, ক্রান্তিকালে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় শীতলক্ষ্যা হবে লক্ষ্যা পাড়ের মানুষের ত্রাণকর্তা।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তারাগঞ্জ কলেজ ও সাধারণ সম্পাদক, কাপাসিয়া প্রেসক্লাব।
এমটিনিউজ/এসএস