সাদিক মৃধা, শ্রীপুর, গাজীপুর থেকে : নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজে ছিলেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগরহাওলা গ্রামের দুই পরিবারের পাঁচ সদস্য। শিশুসহ দুজন মারা গেছেন।
বাকিরা হাসপাতালে। তাঁদের একজন নেপালের কাঠমান্ডু টিচিং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মেহেদী হাসান। উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগমুহূর্তে ঠিক কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে গতকাল বুধবার টেলিফোনে কথা বলেছেন।
‘সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। কেবিন ক্রু সুন্দর করে ঘোষণা দিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমান ল্যান্ড করবে। আমরাও নামবার জন্য প্রস্তুত। বিমানটি যখন অবতরণের জন্য রানওয়ের দিকে এগোচ্ছে, হঠাৎ ভূমির কাছাকাছি এসেও আবার ওপরে উঠে গেল। রানওয়ে ছুঁতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। আমরা জানালা দিয়ে দেখলাম রানওয়েতে কয়েকটি প্লেন দাঁড়িয়ে আছে। তারপর আবারও প্লেনটা ল্যান্ড করার চেষ্টা করে।
এ সময়ই আমরা পরপর দুটো ধাক্কা টের পেলাম। প্লেনের জানালা দিয়ে দেখলাম পাশেই দেয়াল। কয়েক মুহূর্ত পর প্লেনটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। তারপর শুরু হলো আর্তচিৎকার। ভয়ার্ত মানুষ তখন দিশেহারা। কেউ দোয়া পড়ছে, আবার কেউ আতঙ্কে ছোটাছুটি করছে। হঠাৎ দেখি আমার পায়ের কাছ থেকে ধোঁয়া ও আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে।
পাশে তাকিয়ে দেখি আমার স্ত্রী স্বর্ণা (সৈয়দা কামরুন্নাহার) চিৎকার করছে। ও বলছে, “আমি আগুনে পুড়ে যাচ্ছি, আমাকে বাঁচাও। ” আমার সিটবেল্ট খোলা না বাঁধা ছিল, এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে পায়ে কেডস ছিল। আমি দুই হাত, দুই পা দিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে জানালা ভাঙার চেষ্টা করলাম। নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল জানালা ভাঙা গেলে অন্তত নিশ্বাসটা তো নেওয়া যাবে। কিন্তু ভাঙতে পারলাম না।
‘যত দূর মনে পড়ছে, প্রথমে বিমানের পেছনের দিকে আগুন লাগে। সামনে পাইলট যেখানে বসেছিলেন, তাঁর পাশের দরজাসহ প্লেনের কিছুটা অংশ ভেঙে পড়ে গিয়েছিল। আগুন ও ধোঁয়া ঠেলে আমি ওই জায়গায় পৌঁছাই। একটা সুড়ঙ্গের মতো খুঁজে পেলাম। শেষ প্রান্তে সামান্য আলোও।
আমি আলোর পথ ধরে বাইরে বেরিয়ে আসি। বাইরে গিয়ে নিশ্বাস নিয়ে আমি আবার ভেতরে আসি। ভেতরে এসে দেখি অ্যানি (প্রিয়কের স্ত্রী আলমুন নাহার অ্যানি) বের হচ্ছে। আমি এগিয়ে গিয়ে অ্যানিকে বের করে আনি।
তারপর আবারও ভেতরে ঢুকি। দেখি স্বর্ণা বের হওয়ার চেষ্টা করছে। ও তখনো চিৎকার করছে। বলছে, “আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। ” আমি তাকেও দ্রুত বের করলাম। দেখি ওর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। এরপর আমি আর কিছুই মনে করতে পারি না।’
► প্রিয়কের বাড়িতে শুধুই কান্না
মেহেদী হাসানদের সঙ্গেই ছিলেন প্রিয়ক-আলমুন নাহার অ্যানি দম্পতি ও তাঁদের তিন বছরের মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী। আলমুন নাহার স্বামী ও সন্তানকে হারিয়েছেন।
বিকট শব্দে প্লেনটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে প্রিয়ক তাঁর সন্তানকে আনতে প্লেনের ভেতর গিয়েছিলেন। প্রিয়ক ভেতরে ঢোকার পরপরই আগুন আর ধোঁয়ায় চারদিক ছেয়ে যায়। আলমুন নাহার প্রিয়ক বা প্রিয়ন্ময়ী কাউকেই আর দেখতে পাননি।
প্রিয়কের বাড়িতে এখন শুধুই কান্না। প্রিয়কের মা ফিরোজা বেগম সব হারিয়ে নির্বাক। শুধু যেন খোঁজেন কাকে। স্বজনেরা অপেক্ষা করছেন, তাঁদের প্রিয় মানুষগুলোর শবদেহ অন্তত দ্রুত বাড়িতে আসুক।
২০১২ সালে প্রিয়ক বিয়ে করেন। ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তামারা প্রিয়ন্ময়ী প্রিয়কের জন্ম। যেখানেই থাকুক দিনে কয়েকবার মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন। বাবা-মেয়ে চলেও গেলেন একসঙ্গে।
ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছেন প্রিয়কের স্ত্রী আলমুন নাহার ওরফে অ্যানি (২৬), প্রিয়কের মামাতো ভাই মেহেদী হাসান (২৭) ও তাঁর স্ত্রী সৈয়দা কামরুন্নাহার (২৫)। তাঁদের কেউবা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, কেউবা চিকিৎসাধীন আছেন।
এমটিনিউজ২৪/এম.জে/ এস