হায়দার আলী ও মাহাবুব হাসান মেহেদী : এক বিঘা দুই বিঘা নয়, প্রায় ৩০০ বিঘা বনের জমি দখল করে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মূর্তিমান আতঙ্ক জসিম উদ্দিন ইকবাল ওরফে মুচি জসিম। বনের দখল করা জমিতে চারতলা বাড়িসহ একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল মুচি জসিম। একসময় জুতা কারখানার সামান্য পিয়ন হয়ে ওঠে শতকোটি টাকার মালিক। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও নিজের ক্যাডার বাহিনী নিয়ে উপজেলাজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল জসিম।
এমন ভয়ংকর সন্ত্রাসী শতকোটি টাকার মালিক মুচি জসিম নিহত হওয়ার পর কালিয়াকৈরে সাড়ে তিন হাত মাটিও জোটেনি তার কপালে। শত শত বিক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত মুচি জসিমের লাশ নিজ জেলা কিশোরগঞ্জে দাফন করতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, গতকাল শনিবার গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় জসিমের দখলে থাকা প্রায় ৩০০ বিঘা জমি উদ্ধার করা হয়েছে।
গতকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে বন বিভাগের বেদখল জমি উদ্ধার করে সেখানে নতুন চারা গাছও রোপণ করা হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। জসিমের চারতলা বাড়িসহ আশপাশের এলাকার অবৈধ স্থাপনাগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে উদ্ধার করা হয় বনের জমি। অভিযান চলাকালে কালিয়াকৈর উপজেলা প্রশাসন, বন বিভাগের কর্মকর্তা, পুলিশ প্রশাসনসহ প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘গাজীপুর জেলায় আমি যোগদানের পরপরই কালিয়াকৈরের বনের জমি দখলের বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত আসে। আমি সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে সংরক্ষণ করি। সকল প্রক্রিয়া শেষে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় শনিবার দুপুরে সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালাই। জসিমের দখলে থাকা পুরো জমি উদ্ধার করে বন সৃজন করে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আজই (শনিবার) আমরা চারা গাছ রোপণ করে দিব। সকল প্রস্তুতি ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে। উচ্ছেদ কার্যক্রম শেষে সেখানে গাছের চারা রোপণ করা হবে। যেন সেখানের বনের জমিতে বনের পরিবেশ ফিরে আসে। এসব বনের জমি উদ্ধার করে বন বিভাগকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুঝিয়ে দেওয়ার আগে শর্ত একটাই, উদ্ধার করা জমি খালি রাখা যাবে না। জমিতে চারা লাগাতে হবে।
জসিমের দখলে থাকা জমি নয় শুধু, অন্যদের দখলে থাকা জমিও উদ্ধারের কথা জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘অন্যান্য বনের বেদখল হওয়া জমিও উদ্ধার করা হবে। পাশাপাশি বনের জমি দখল করে যেসব হোটেল মোটেল তৈরি করা হয়েছে সেগুলোও উচ্ছেদ করা হবে। দখলকারীরা যত বড় প্রভাবশালী হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় জসিমের সাম্রাজ্য : ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে উপজেলার চন্দ্রা পল্লী বিদ্যুৎ জোড়াপাম্প এলাকায় প্রায় ৩০০ বিঘা বনের জমি দখল করে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে মুচি জসিম ও তার লোকজন। পুরনো গজারিগাছ কেটে অবৈধভাবে বাড়িঘর নির্মাণ করে ‘নতুনপাড়া’ নামে একটি গ্রাম গড়ে তোলা হয়।
কয়েক বছর আগেও ওই এলাকা শাল-গজারির গভীর অরণ্যে ঘেরা ছিল। রাতারাতি পুরো বনাঞ্চল বিরানভূমিতে পরিণত হয়। গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক বসতভিটা। বন বিভাগের জমিতে গড়ে তোলা নতুনপাড়ায় মুচি জসিম তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বনের জমি প্লট হিসেবে বিক্রি করে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। এভাবে তিন শতাধিক পরিবারের কাছে প্লট বিক্রি করা হয়। বন বিভাগের জায়গা জসিমের কাছ থেকে ক্রয় করে লোকজন সেখানে বসবাস করতে শুরু করে।
ওই জমি উদ্ধার করতে গিয়ে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের হামলা এবং মিথ্যা মামলার শিকারও হতে হয়েছিল অনেকবার। ওই সব ঘটনায় মুচি জসিম ও তার ক্যাডার বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা করেও বনের জমি উদ্ধার করা যায়নি। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে জসিম। সে নিহত হওয়ার পর প্রশাসন ওই জমি উদ্ধারের পদক্ষেপ নেয়। গতকাল দুপুরে দুটি ভেকু, একটি বুলডোজার ও ৭০ জন বন প্রহরী, ২০০ লেবার ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে ওই এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়।
এ সময় বনের জমিতে গড়ে তোলা মুচি জসিমের বিলাসবহুল বাড়ি রাশিদা কুটির ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। উচ্ছেদ করা হয় বন বিভাগে গড়ে তোলা শতাধিক অবৈধ স্থাপনা। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মশিউর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সঞ্জিব কুমার দেবনাথ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জান্নাতুল ফেরদৌস, গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল শেখ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম সবুর উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নেন।
এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ইউসুফ, এএসপি শাহিদুল ইসলাম, সহকারী বন সংরক্ষক এনামুল হক, এএসপি শোভন চন্দ্র, এএসপি শরীফ আল রাজীব, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ও কালিয়াকৈর থানার ওসি রফিকুল ইসলাম।
কালিয়াকৈরে জসিমের লাশ দাফন করতে দেয়নি বিক্ষুব্ধ মানুষ : নিহত মুচি জসিমের লাশ গাজীপুর তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে দাফনের জন্য আনা হয় কালিয়াকৈর জোড়াপাম্পের সামনে জসিমের বাড়ির সামনে। আগে থেকে মুচি জসিমকে দাফনের জন্য কবর খুঁড়ে রাখাও ছিল।
কালিয়াকৈর থানার ওসি রফিকুল ইসলাম ও পরিদর্শক তদন্ত মাসুদ আলমসহ পুলিশের একটি দল কালিয়াকৈরের জোড়াপাম্প এলাকায় জসিমকে দাফন করতে চাইলেও স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা সেখানে জসিমের লাশ দাফন না করতে বাধা দেয়। পরে বিক্ষোভ মিছিল করে। জসিমের জন্য খোঁড়া কবরটি মাটি দিয়ে ভরে ফেলে বিক্ষুব্ধ জনতা। শেষে নিরুপায় হয়ে মুচি জসিমের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে।
স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, ‘ভয়ংকর ত্রাস মুচি জসিমের লাশ কালিয়াকৈরের মাটিতে দাফন হতে পারে না। স্থানীয় বাসিন্দা আসাদুজ্জামান আসাদ, মাসুদ রানা, সুমন রানা, বাবুসহ অনেকে বলেন, ‘নতুন পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার গাজীপুরবাসীর জন্য এক সাহসীকা নারী। আর জেলা প্রশাসক একজন সৎ এবং যোগ্য ব্যক্তি। তাঁদের নির্দেশনায় আশা করছি গাজীপুর সন্ত্রাস এবং মাদকমুক্ত জেলায় পরিণত হবে।’
মুচি জসিম নিহত এবং তার সাম্রাজ্য গুঁড়িয়ে দেওয়া, তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের বিতাড়িত করায় উল্লাস প্রকাশ করেছে উপজেলার সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা মিষ্টি বিতরণ করেন। গতকাল উপজেলার চন্দ্রা কার্যালয়ে সভা করে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়।
ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোশারফ সিকদার, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুরাদ কবীর, পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আব্দুল হক মিয়া, পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক বেলায়েত হোসেন বাবু ও শরীফ মণ্ডল; উপজেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান, কৃষক লীগের সভাপতি আবুল কাশেম, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নাজমুল হাসান ও পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সুমন রানা প্রমুখ।-কালের কণ্ঠ