শরীফ আহমেদ শামীম, গাজীপুর: গাজীপুর জেলায় বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বেড়েছে। ২০২২ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা এবং পাঁচটি উপজেলায় মোট বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে ২০ হাজার ২৮৫টি। তালাকের ঘটনা ১০ হাজার ৭১২টি। অর্থাৎ গত বছর গাজীপুরে প্রতি ৪৯ মিনিটে ভেঙেছে একটি করে সংসার। বিচ্ছেদের ঘটনা সবচেয়ে বেশি কালিয়াকৈর উপজেলায়।
নিকাহ রেজিস্ট্রারের কার্যালয় (কাজী অফিস) ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিবাহবিচ্ছেদ সালিসি আদালত সূত্রে জানা গেছে, তালাকের আবেদন নারীরাই বেশি করেছেন। তাঁদের অভিযোগের মধ্যে রয়েছে নিজের আয়ের টাকায় স্বামীর ভাগ বসানো, ভরণ-পোষণে স্বামীর অক্ষমতা, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, মনের মিল না হওয়া ইত্যাদি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের গাজীপুর মহানগর শাখার নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, তালাকের ঘটনা কমাতে সুশিক্ষা, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা এবং পারস্পরিক মমত্ববোধ বৃদ্ধি প্রয়োজন।
জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সালিসি আদালতে বিবাহবিচ্ছেদ আবেদন জমা পড়েছে এক হাজার ৩২টি। এর মধ্যে স্ত্রীর আবেদন ৬৯৬টি, স্বামীর আবেদন ৩০৫টি। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে মিলে যৌথ আবেদন ৩১টি।
গাজীপুর মহানগরের জরুন এলাকার এক তরুণের সঙ্গে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মঙ্গলহোড় গ্রামের এক তরুণীর বিয়ে হয় গত ১৫ জুন। এক মাস যেতে না যেতে ঘটে গেছে বিচ্ছেদ। গত ১৫ জুলাই স্বামীকে তালাক দেন তরুণী। স্বামীর বিরুদ্ধে তিনি ভরণ-পোষণ না দেওয়া ও মারধরের অভিযোগ তুলেছেন।
জানতে চাইলে স্ত্রীর অভিযোগ অস্বীকার করে ওই তরুণ বলেন, অনেক বুঝিয়েও স্ত্রীকে বাড়ি ফেরাতে পারেননি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ওই তরুণী বলেন, স্বামীর সঙ্গে তাঁর মতের মিল হচ্ছিল না।
অন্য এক ঘটনায় ১৬ বছর সংসার করার পর স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন শ্রীপুরের এক ব্যক্তি। দুই সন্তানের জনক ওই ব্যক্তির ভাষ্য, তিনি ইতালিপ্রবাসী ছিলেন। তাঁর ১২ ও সাড়ে চার বছরের দুই ছেলের জন্মও ইতালিতে। বছর তিনেক আগে স্ত্রী অন্যের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর পর থেকে সংসারে অশান্তি। দেশে ফিরে ফ্ল্যাট-জমি লিখে দেওয়ার কথা বলেও স্ত্রীকে ফেরাতে পারেননি। উল্টো তাঁর নামে যৌতুক ও নারী নির্যাতন মামলা করে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। তাই বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন।
প্রবাসীর সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁর বাবা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাঁর মেয়েকে তালাক দেওয়া হয়েছে। জামাই তাঁর মেয়েকে তুচ্ছ কারণে নির্যাতন করতেন।
বিয়ের চেয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি কালিয়াকৈর উপজেলায়। ২০২২ সালে ওই উপজেলায় বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে এক হাজার ২৬৩টি। বিচ্ছেদ ঘটেছে এক হাজার ৭১৬টি। বিয়ের চেয়ে তালাকের ঘটনা বেশি ৪৬৩টি। জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য মতে, গত বছর কালিয়াকৈরের শুধু মৌচাক ইউনিয়নেই তালাক হয়েছে ৪১৯টি। ওই সময়ে মৌচাক ইউনিয়নে বিয়ে হয়েছে মাত্র ২১১টি।
মৌচাকে বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি হওয়ার বিষয়ে ওই ইউনিয়নের কাজী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এই এলাকায় বিয়ে ও বিচ্ছেদের ঘটনা ৯৮ ভাগই কাজের সূত্রে আসা অন্য জেলার শ্রমিকদের মধ্যে ঘটছে। ভিন্ন জেলা থেকে এসে একই কারখানায় কাজ করার সূত্রে পরিচয়-সম্পর্ক, তারপর বিয়ে। কাজ না করে স্ত্রীর আয়ের ওপর নির্ভর করা, আগের সংসারের তথ্য গোপন রেখে বিয়ে, শারীরিক নির্যাতন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ইত্যাদি কারণে নারীরা স্বামীকে তালাক দিচ্ছেন। দেখা গেছে, বিয়ের পর স্বামী কাজ না করে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছেন। একার আয়ে সংসার চালাতে গিয়ে দ্বিগুণ শ্রম দিতে হচ্ছে স্ত্রীকে। এতে একসময় বিরোধ দেখা দেয়। স্ত্রী বেছে নেয় বিচ্ছেদের মতো সমাধান।
তিনি বলেন, আবার দেখা যায়, স্ত্রী তাঁর উপার্জনের এক টাকাও স্বামীকে দিতে চান না। স্বামীকে একাই সংসার টানতে হয়। এ নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তালাকের ঘটনা ঘটে। গাজীপুর জেলা নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির সভাপতি কাজী মো. শরীফ হোসেন বলেন, জীবনসঙ্গীকে সন্দেহ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিমাত্রায় আসক্তি, মাদকাসক্তি ইত্যাদি কারণেও তালাক বেড়েছে। বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারী এগিয়ে থাকার মূল কারণ এসংক্রান্ত আইন অনেকটা তাদের অনুকূলে। পুরুষের পক্ষে সেভাবে কোনো আইন নেই। স্বামী তালাক দিলে স্ত্রী বিভিন্ন ধারায় মামলা করতে পারেন। ধারাগুলো জামিন অযোগ্য। তাই হয়রানির ভয়ে স্বামী সহজে তালাক দিতে চান না।
বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য ভাষাশহীদ কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মুকুল কুমার মল্লিক বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহানুভূতির অভাব, জীবনযাপনের ধারার মধ্যে বৈপরীত্য, বিভিন্ন কারণে পরস্পরকে সময় না দেওয়া এবং অর্থনৈতিক কারণে বিচ্ছেদের ঘটনা অনেক বেড়েছে। বিষয়টি খুব উদ্বেগজনক। বিচ্ছেদের প্রভাব সন্তান ও পরিবারের ওপর পড়ে। পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়। সামাজিক জীবনে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। এ জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।-কালের কণ্ঠ