গাজীপুর: হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রোববার বাড়ি থেকে বের হন শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটী ইউনিয়নের টেংরা এলাকার মেহেরুন নেসা। সঙ্গে ছিল তার নাতনি জায়মা ও ভাতিজি নাসরিন মণ্ডল। সকালে হাসপাতালে নাতনির কপালের টিউমার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণের কথা ছিল। পরিবারের সবাই জানত দুপুরের মধ্যেই তারা ফিরে আসবে।
কিন্তু দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, রাত, এমনকি পরদিন সকালও যায়। তাদের খোঁজে স্বজনরা বাধ্য হন থানায় জিডি করতে। কিন্তু এর পরও তাদের সন্ধান মিলছিল না। সোমবার দুপুরের দিকে পুলিশের কাছে খবর আসে, সিরাজগঞ্জে যমুনা নদী থেকে বস্তাবন্দি দুই নারী ও এক শিশুর লাশ উদ্ধার হয়েছে।
লাশ উদ্ধারের পরই পরিচয় নিশ্চিত করেন স্বজনরা। যমুনার পানিতে ভেসে ওঠা ওই লাশ শ্রীপুরে নিখোঁজ শিশুসহ তিনজনের। এরপর শ্রীপুর থানা পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নাসরিনের দ্বিতীয় স্বামী আল আমিনসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে।
পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছে, আল আমিন সংসার করার বিষয়ে জানতে গিয়েই প্রথমে নাসরিনকে গলাটিপে হত্যা করে। এরপর শিশুসহ অপর দু'জনকে হত্যা করা হয়।
নিহতরা হলেন টেংরা এলাকার হাদিউল ইসলামের স্ত্রী মেহেরুন নেসা (৪৮), তার পালিত কন্যা রিমি আক্তারের মেয়ে জায়মা আক্তার (৪) ও টেংরা গ্রামের বাদল মণ্ডলের স্ত্রী নাসরিন মণ্ডল (৩০)। গ্রেফতারকৃতরা হলো_ সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার চালা অফিসপাড়ার আবদুল মান্নানের ছেলে আল আমিন, রায়গঞ্জ উপজেলার জাংগায়াদি গ্রামের মাহাবুবুল আলমের ছেলে নয়ন ও জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার পবাহার লোহাপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে রবিউল ইসলাম।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় লাশ বহনে ব্যবহৃত কারটিও উদ্ধার করা হয়। আল আমিন গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ির মো. মনির হোসেনের মালিকানাধীন 'রিজভী-মীম-নিশি বস্ত্রালয়ের' ম্যানেজার। নয়ন ওই দোকানের কর্মচারী এবং রবিউল দোকান মালিক মনির হোসেনের কারচালক।
শ্রীপুর থানা পুলিশ জানায়, বাদল মণ্ডল নাসরিনের প্রথম স্বামী। ২০১০ সালে নাসরিন প্রেম করে আল আমিনকে বিয়ে করেন। সেখানে ১১ দিন সংসার করার পর আবার বাদল মিয়ার সংসারে ফিরে যান। প্রতিবেশীরা জানান, আল আমিনকে ছেড়ে দিলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল নাসরিনের। বিভিন্ন স্থানে তাদের ঘুরে বেড়াতেও দেখা যেত।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, মাওনা চৌরাস্তার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর আল আমিন গড়গড়িয়া নতুন বাজার এলাকার মনিরের দোকানে তাদের কৌশলে নিয়ে যায়। সেখানে নাসরিনের সঙ্গে দাম্পত্য বিষয় নিয়ে তার কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে নাসরিনকে সে গলাটিপে হত্যা করে। পরে ঘটনা জানাজানির ভয়ে নয়ন ও রবিউলকে সঙ্গে নিয়ে অপর দু'জনকেও একইভাবে হত্যা করা হয়।
পুলিশের হেফাজতে থাকা আল আমিন সাংবাদিকদের বলে, 'জীবনের একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানার জন্য নাসরিনকে নিরিবিলি ওই জায়গায় নিয়েছিলাম। তার কাছে জানতে চাইছিলাম_ 'তুমি কার সংসার করবে? একজন নারী তো দু'জনের সংসার করতে পারে না।
হয় আমারটা, নয় বাদলেরটা করো। নাসরিন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দেরি করছিল বলে তার গলা চেপে ধরি। এক পর্যায়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং পরে শ্বাসরোধে তার মৃত্যু নিশ্চিত করি।'
শ্রীপুর থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে জায়মা ও মেহেরুন নেসা নির্মম ওই হত্যার দৃশ্য দেখে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করেন। পরে তাদেরও সহযোগীদের নিয়ে হত্যা করে আল আমিন।
তিনি আরও বলেন, হত্যার পর তিনজনের মৃতদেহ বস্তাবন্দি করা হয়। পরে দোকান মালিকের গাড়িতে তুলে লাশগুলো সিরাজগঞ্জ নিয়ে যমুনা নদীতে ফেলে রাতেই তারা শ্রীপুর ফিরে আসে।
গাজীপুরের এসপি মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, আল আমিন বন্যা পরিস্থিতি দেখার জন্য গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ যাওয়ার কথা বলে দোকান মালিকের কাছ থেকে কারটি নেয়। তিনি বলেন, ঘটনার রাতে লাশগুলো বস্তাবন্দি করে গাড়ির পেছনে তুলে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় খাজা খানজাহান আলী মেডিকেল কলেজের পাশে যমুনা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
লাশ উদ্ধারের ঘটনায় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় একটি মামলায় হয়েছে।-সমকাল
৩ আগস্ট, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ