নাজমুন নাহার : ঐতিহ্যকে অনুসন্ধান করাই শুধু নয়, এর পেছনে তিল তিল সময় দিয়েছেন। কিন্তু এটুকুই আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের একমাত্র পরিচয় নয়। শিরায় শিরায় তিনি ধারণ করেন সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা এবং একনিষ্ঠতা। সাহিত্য অন্তরের ব্যাপার এটা তাঁর বিশ্বাস ছিলো। আর সেই সাধনায় তিনি আজীবন নিজেকে যুক্ত রেখেছেন সাহিত্যের সাথে। তাঁর কথা ছিলো আসলে এখানে তো কোনো ফাঁকি ঝুকি চলে না। যে সাহিত্যকর্মে ফাঁক আছে সে কখনোই টিকে থাকবে না।
একনিষ্ঠতা, সততা এবং সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা এই সাধনায় ব্রত থেকেই তিনি একটা শক্ত প্ল্যাটফরম তৈরি করেন বাংলা সাহিত্যের জন্য। বাংলা সাহিত্যের পেছনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখেন বাঙালি পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের অবস্থা শোচনীয়। যদিও রেনেসাঁর অগ্রগ্রামী পুরুষ বেশীর ভাগই হিন্দুরা ছিলেন কিন্তু মুসলমানরা পিছিয়ে ছিলেন অনেকটাই। তিনি সেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের সামনের দিকে এগিয়ে আনার জন্য তিনি সর্বাত্মক ভাবে কলম ধরেন।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ( ১৮৭১-১৯৫৩) মেধাবী, সৃজনশীল, পরিশ্রমী সাহিত্যিক ছিলেন। সাহিত্য রচনার প্রথম দিক থেকেই তিনি সুধীমহলের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশ শতকের প্রারম্ভে বিদ্যাবুদ্ধি, সামাজিক প্রতিপত্তি সবদিক দিয়ে পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী লেখক সংস্কারের কাজে নিয়োজিত হন। মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ -৯১ সময়কালে।
১৯১০ -১৫ সালের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেন কায়কোবাদ, মুন্সী জমির উদ্দিন, মুন্সী মেহের উল্লাহ ,মোজাম্মেল হক, মোহাম্মদ রেয়াজ উদ্দিন, আহমেদ মাশহাদী, শেখ আবদুর রহীম, মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, নজিবুর রহমান, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ।
তাঁরা মুসলিম জাগরণের কাজ সূচিত করেছিলেন। পত্র পত্রিকা প্রকাশ জরুরি, যদি কোন সমাজ জাগাতে হয় এই বিষয়টি তারা বুঝতে পেরেছিলেন। আবদুল করিম নবনূর, কোহিনূর, সাওগাত সাধনা পুজারী প্রভৃতির সাথে যুক্ত হন। প্রায় চল্লিশটি পত্রিকার গ্রাহক, প্রধান অপ্রধান মফস্বলীয় নাগরিক, ডান বাম ধর্মপন্থী সকল পত্রিকার লেখক এবং হাতে লেখা পুঁথির সংগে সংগে মুদ্রিত পত্রপত্রিকা, পুস্তিকার মহৎ সমঝদার সংরক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী। খণ্ডিত বাংলার জাগরণকে পূর্ণতা দানের জন্য ছিলো তাঁর মুসলিম ঐতিহ্যনুসন্ধান। আবদুল করিমের দৃষ্টিতে ছিলো হিন্দু মুসলামানের সম্মিলিত সম্ভাবনাময় বৃহত্তর বাঙালি জাতি।
আবদুল করিমের এই সংগ্রামী তাৎপর্যমণ্ডিত জীবন সাধনার মূল্যায়নে একজন বিখ্যাত লেখকের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
‘সাধারণের চোখে নিতান্ত তুচ্ছ অনাকর্ষণীয় ও অপাঠ্য পুঁথির জন্য আত্মোৎসর্গ করেছেন বলেই হয়তো অসামান্য অতুল্য সাধক আবদুল করিমের গুণমাহাত্ম্য রয়েছে অস্বীকৃত আর তাঁর শ্রম সাধনা একাগ্রতা এড়িয়ে গেছে লোকের দৃষ্টি। তাই তিনি সারাজীবন প্রাপ্য সম্মান শ্রদ্ধা সাহায্য সমর্থন পাননি প্রত্যাশিত মাত্রায় এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণে। তাঁর প্রিয় কবি আলাওলের পদ্মাবতী মুদ্রণের জন্য অর্থ সাহায্য মেলেনি। তিনি ব্যর্থতার বেদনা নিয়ে বিদায় নিয়েছেন জগত সংসার থেকে।’
তৎকালীন রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে, দরিদ্র মুসলমান সমাজ বৃহত্তর অংশ হলে ও তাঁরা ছিলেন নিষ্প্রভ। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পশ্চাৎপদ। শিক্ষিত সমাজের পাঠযোগ্য কোন রচনা বা গ্রন্থ ছিলো না। সেই অবস্থায় আবদুল করিমের ইতিহাস জ্ঞান তাঁকে বাংলার ঐতিহ্য সন্ধানে আগ্রহী করে তুলে।
১৮৯৪ সালে যখন তিনি লেখক হিসেবে কলম ধরেন তখন মৃত্যুবরণ করেন বাংলার শ্রেষ্ঠ মনীষী বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই ১৮৯৪ সালেই জন্মগ্রহণ করেন মুসলিম বাংলার অন্যতম চিন্তাবিদ আব্দুল ওদুল। কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম আসন্ন। তখন আবদুল করিম কোলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিতব্য নরোত্তম ঠাকুরের ”রাধিকার মানভঙ্গ (১৯০১) গ্রন্থের পান্ডুলিপি প্রণয়নের সাধনায় রত। এই পুঁথির মুখবন্ধ লিখেন আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী - ’গ্রন্থের সম্পাদনা কার্যে যেরূপ কৌশল , যেরূপ সহৃদয়তা ও যেরূপ সুক্ষ্মদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন তাহা সমস্ত বাংলায় কেন সমস্ত ভারতেও বোধ হয় সচরাচর মিলে না। এক একবার মনে হয় যেন কোন জার্মান এডিটর গ্রন্থ সম্পাদন করিয়াছেন ” আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে কেউ বলেছেন পুঁথির কুবের কেউ বলেছেন যুগপুরুষ। একজন পুঁথির সংগ্রাহক যে যুগপুরুষ হতে পারেন কেবল সাহিত্য কেন, আমাদের মনন ও চিন্তার বিকাশের ইতিহাসে তার নজির কেবল আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। গ্রামে গ্রামে পুঁথি খুঁজে বেড়ানো মানুষটিই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট লেখক। আবার তাঁর এই লেখক সত্তা তাঁর সংগৃহীত পুঁথির নীচে চাপা পড়ে গেছে । একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সময়ে যুগসন্ধির সংকটকালে তিনি ধর্ম নিরপেক্ষ উন্নত দৃষ্টি ও প্রগতিশীল জাতীয় চেতনার দ্বিধাহীন প্রবক্তার ভূমিকা পালন করেছেন।
আবদুল করিম লিখেছেন প্রায় ৪৫০ টি প্রবন্ধ নিবন্ধ। সংগ্রহ করেন প্রায় এক হাজার পুঁথি। এগুলোর বিবরণ ও বর্ণনা বিধিবদ্ধ হয়েছে। তাঁর লেখার বিষয় - ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম সমাজ , সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, নৃতত্ত্ব ও ইতিহাস। তাঁর রচনার সবই কেজো সাহিত্য। এসবই কাজে লেগেছে বাঙালির জাতীয় জীবনে, সন্ধিক্ষণ থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে।
অথচ তাঁর কেজো প্রবন্ধগুলো অবিন্যস্ত, অগ্রন্থিত। এক্ষেত্রে আহমেদ শরীফ তাঁর রচনাগুলোর একটা তালিকা অসম্পূর্ণ হলেও প্রস্তুত করেছেন যেগুলো এখন দিক নির্দেশনার মতন কাজ করে।
জাতিকে পথের দিশা দেওয়ার জন্যই সাম্প্রতিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিতর্কে অংশ নিয়ে লিখেছিলেন এসব প্রবন্ধ। তাঁর রচনায় তাঁর ব্যক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য ও যুক্তির প্রাখর্য ছিলো। মুক্তবুদ্ধির চর্চায় তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য।
আবদুল করিম সাহিত্যিক জীবন শুরু করেছিলেন ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গীকারবশত পুঁথি সংগ্রহের কাজের মধ্য দিয়ে। বাঙালির ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন বাংলা ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এই প্রসংগে তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার।
‘সাহিত্যের ইতিহাস ও মূলধারার সংগে পরিচিত না হইয়া তাহাকে আত্মস্থ না করিয়া দুই চারিটি কবিতা বা প্রবন্ধ কিছু গল্প উপন্যাস বা নাটক যে লেখা যায় না তাহা নহে। কিন্তু এইভাবে সাহিত্য স্রষ্টা কখনো হওয়া যায় না , হওয়া যায় না ফেরদৌসী বা গ্যেটে, শেক্সপিয়ার বা বানার্ডশ, ইকবাল বা নজরুল ইসলাম অথবা মধুসূদন বা রবীন্দ্রনাথ।’
সাহিত্যে যে কোন শর্টকাট নাই এটা তিনি বার বার বলেছেন। ফাঁকি চলে না, জাদুবিদ্যা চলে না। এমনকি প্রদর্শনীতে অথবা মঞ্চে জাদুবিদ্যার কারিশমাও থাকে না সাহিত্য ক্ষেত্রে। যেমন শেক্সপীয়ার যখন লিখেন তিনি ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করেছেন এবং তাঁর অধিকাংশ নাটক পূরানের উপকরণ, ইতিহাস, কিংবদন্তী এবং লোকগাঁথা। ইকবাল ও নজরুল যদি পড়ে দেখা যায় দেখা যাবে প্রাচীন ইতিহাস ও সাহিত্যের কত সব বিচিত্র উপকরণ ছড়িয়ে আছে। এমনকি অত্যাধুনিক বানার্ডশ পর্যন্ত প্রাচীনকে অতীত কাহিনীকে সাহিত্যের উপকরণ না করে পারেন নাই। ঐতিহ্য অন্বেষনে তাঁর সারাজীবন ব্যয় করার পেছনে তিনি বার বার এভাবে তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৫০ সালে একটি অনুষ্ঠানের সভাপতির অভিভাষণে বলেন -বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবের, আপনাদের মনে যদি বিশ্বাস ও আন্তরিকতা থাকে তাহা হইলে এই সাহিত্যের ভবিষ্যৎ অধিকতর গৌরবশালী হইবে।” ঐতিহ্যের প্রেম সংস্কৃতি সাধনার আসল সোপান। অতীত আমাদের ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শন করে । সেই আলোকে আমাদের বর্তমান নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।
ঐতিহ্য হলো এমন শক্তি যে একে স্বীকার করতে হবে। কিন্তু স্বীকার করে বসে থাকলে হবে না। সেটা গতানুগতিকতা। গতানুগতিকতা মানে হলো সাহিত্যের মৃত্যু। কেননা সাহিত্য সবসময় নতুন পথে যেতে চায়। ঐতিহ্যকে স্বীকার করার পর প্রবাহকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে হবে । যেমন বিদ্যাপতি অনেক বড় কবি নিঃসন্দেহে। কিন্তু আরো নানা কবি নানা রকমের কাব্যত্ব সৃষ্টি না করলে কাব্য লক্ষীর মৃত্যু ঘটতো।
সেক্ষেত্রে আবদুল করিম বলেন” আমি কঙ্কালের ব্যবসায়ী। পুরাতন পুঁথি কংকালের মতই। কিন্তু আমি তার ভেতর যুগ যুগান্তরের রক্তধমনী ও নিঃশ্বাসের প্রবাহধ্বনি শুনিয়াছি। আমার বিশ্বাস, সে যুগের শিল্প স্রষ্টাদের পক্ষে যা সত্য ছিলো, আজো তার বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটে নাই। ” আবদুল করিমের মতে দেশের ইতিহাস এইজন্যই উত্তম রূপে জানা দরকার । পুঁথি সাহিত্য বাংলার বিভিন্ন যুগের উপর আলোকপাত করতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। ঐতিহ্যের সাথে দেশের ইতিহাস , ধর্ম ভাষা , লৌকিক আচার জলবায়ু গাছপালা এমনকি তরুলতা পর্যন্ত জড়িত। বুকে দেশপ্রেম না থাকলে সেটি যে কাউকেও বুঝিয়ে দেয়া যায় না সেটা তিনি মনে করতেন। ঐতিহ্য অন্বেষনের অংশ হিসেবে পুঁথি সাহিত্যের সংগ্রহ এবং এর পেছনে তাঁর ছুটে যাওয়া ছিল সাধনার মত। একটি অভিভাষণে তিনি বলেন -” লিপিস্টিকের রঙ্গে ঠোঁট রাঙা হইতে পারে কিন্তু দিল রাঙা হয় না । অথচ সাহিত্য হইতেছে দিলি জিনিস । মুখের বুলি যখন দিলের বুলি হইয়া উঠে তখনই মাত্র তাহা সাহিত্যের বস্তু হইতে পারে।
মোট কথা বিচার করিয়া দেখিতে হইবে সাহিত্য হইয়া উঠিয়াছে কিনা। ”
যুগে যুগে সমাজ পরিবর্তন হয়। এক যুগের শিল্প রীতি নিয়ে অন্য যুগের সমাজকে আঁকা চলে না। রীতিও যেমন পরিবর্তিত হয়। নক্ষত্রের অবস্থান দেখে জ্যোতির্বিদগণ পৃথিবীর গতিশীলতা স্থির করেন। আবার শিল্পরীতি দেখেও আমরা একটা সমাজের গতিশীলতা বুঝতে পারি। আবার সমাজের কলেবর দর্শনেও সমাজের গতিশীলতা বুঝতে পারা যায় । প্রাচীন শিল্পীরীতিগণ তা ভালোভাবে উপলব্ধি করেছেন। সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত ছিলো বলে মধ্যযুগের সার্থক কবিগণ লোক সংস্কৃতি আগ্রাহ্য করেন নি। এই সত্যি আবদুল করিম উপলদ্ধি করেছেন এবং জানান মঙ্গল কাব্যগুলো সাধারণত দরবারী রাজসভা ঘেঁষা কিন্তু এর ভেতরেও পল্লীজীবনের ঝংকার স্পষ্ট ছিলো। বারমাস্যার সুর কখনই বাদ দেন নাই।
প্রকৃত কবি দুঃখবেদনার শরীক । তা বাদ দেয়া যায় না । আবার স্থান বিশেষে তদানীন্তন রাজসভা ও পল্লীর আসর দুই জায়গায় দুই রকম রূপ পরিগ্রহ করেছে । কিন্তু দুয়ের ভেতর একটা ঐক্য আছে । চৈতন্যমঙ্গল , চৈতন্যভাগবত ইত্যাদি মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব কবিতা দুয়ের সুরের আলাদা রূপ , রচনার অনুপ্রেরণা যদিও একটি জায়গাই । এভাবে স্থান কাল পাত্র ভেদে সাহিত্যের আদর্শ পরিবর্তনশীল ।
আবদুল করিম মনে করেন এটি লক্ষ্য করবার জন্য সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই ।
আবার তাঁর মতে দৃষ্টিশক্তির সাধনার প্রয়োজন আছে । প্রাচীন কবিরা এ পথ দেখিয়েছেন । তা এক শব্দে বলা যায় উদারতা । যে যত উদার , তার দৃষ্টি তত স্বচ্ছ । কারণ হৃদয়ও দর্পনের মত স্বচ্ছ হয়ে আসে । এর উপরই পড়ে সমাজের প্রতিবিম্ব। দর্পনের স্বচ্ছতার উপর প্রতিবিম্বের স্পষ্টতা নির্ভর করে । এবং এখানে শিল্পী কোন চাতুরতার আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেন না ।
আমার পথ ঢাইকাছে মন্দিরে মসজেদে
ওরে ও পরম গুরু সাঁই
তোর পথ দেখিতে না পাই
আমায় রুখে দাঁড়ায় গুরুতে মোরশেদে ”
আবদুল করিম বলেন প্রাচীন বাউল কবির মুখে সহজেই এই বাণী নিসৃত হয়েছিলো। অশিক্ষিত, অজ্ঞাত, কুলশীল কবির হৃদয়ের আর্তনাদ আজও কানে আসে। মানুষে মানুষে ঐক্যের চেষ্টা ছিলো তাঁদের সাধনা। কিন্তু প্রাচীন কবির বাণী আজো সার্থক হয় নি। ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব , হানাহানি লোভ জিঘাংসা রিপুর নানা জঘণ্য চিত্র আজ ও আমাদের দৈনন্দিন ঘটনার পটভূমি।
আবদুল করিম ব্যথিত হন ” সাম্প্রদায়িকতা মহামারী বীজের মত শত শত গ্রাম মানুষের নীড় ধ্বংস করিয়াছে । তাই এই জাতীয় দুর্দিনে বিভেদ আছে সত্য - এই বিভেদকে জয় করাই সংস্কৃতির কাজ। সংস্কৃতি ঐক্যের বাহন - বিভেদের চামুন্ডা নয়। ”
আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ বরাবর ছিলেন অসাম্প্রদায়িক , জাতির প্রতি মানুষের প্রতি তাঁর দরদ সীমাহীন। এই কারণে বার বার তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন মানুষকে। তাঁর মতে সাহিত্যের প্রধান উপকরণ মানুষ। যিনি মানুষের অন্তরে প্রবেশ করতে পারেন তিনিই সত্যিকারের সাহিত্য রচনা করতে পারেন । এবং মানুষের অন্তরে প্রবেশ করার পথ হলো প্রেমের পথ , প্রীতির পথ ।
তিনি মনে করতেন দেশের প্রতি জাতির প্রতি মানুষের প্রতি চতুর্দিকের প্রকৃতি ও পরিবেষ্টনের প্রতি যাঁর অন্তরে অফুরন্ত ও ভালোবাসা বিরাজ করে তাঁর রচনা সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করবে এ ব্যপারে তাঁর বিশ্বাস ছিলো ।
ইংরেজ রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পর অর্থাৎ ১৮০০ সাল থেকে যে জাগরণ তথা রেনেসাঁ এসেছিল এই উপমহাদেশে সেখানে বলা যায় হিন্দু জাগরণই ঘটেছিলো । আবদুল করিম তাঁর যৌবনকালে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব অনুভব করেছিলেন । সেই সকল যুগ মনীষীদের অনেকেই স্বচক্ষে দেখবার এবং সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল । উনবিংশ শতকের শেষের দিকে মুসলিম জাগরণের যে ক্ষীণ ধারা বেগবতী হিন্দু ধারার পাশাপাশি চলতে আরম্ভ করলো তার সংগেও তাঁর প্রত্যক্ষ যোগ ছিলো । আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদই একজন ব্যক্তি যিনি হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালির কাছে বিস্মৃত মুসলিম সাহিত্যের অবদানের সন্ধান দিয়েছিলেন । মধ্যযুগের এই সাহিত্যের সন্ধান , উদ্ধার ,পঠন ও গবেষনা কার্যে কৈশোর হইতে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অক্লান্তভাবে জীবনের প্রতিটি দিন ব্যয় করেছেন । তার ধন সম্পদ ছিলো না । এক জীবনে যা কিছু সম্ভব তার সবটুকু তিনি করতে পারেননি এই আফসোস তাঁর ছিলো । কিন্তু তাঁর চাইতেও বড় আফসোস ছিলো মুসলমানদের।
এই বিষয়ে অনেক বার আহবান করেছেন তাকে সহযোগিতা করার জন্যে । কিন্তু কেউ সহযোগিতা করেন নি । এর ফলে যে দুঃসাধ্য সাধনায় তিনি ব্রতী হয়েছিলেন তা সহায় সম্বল সহযোগী সম্পদের অভাবে সফল হয় নি । কিন্তু তিনি অন্তত এই ভেবে তৃপ্তি পেয়েছেন যেটুকু তিনি সন্ধান দিয়েছেন তাতে মুসলমানদের হীনমন্যতা ঘুচেছে ।
আবদুল করিম সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন । সে হলো
জাতির ধর্মবোধ এবং রাষ্ট্রীয় বোধের সাথে সাহিত্য জড়িত । তাঁর বিশ্বাস ছিলো -সাহিত্য ধর্ম ও সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় বোধের প্রেরণা যোগায় অথবা বিশিষ্ট ধর্ম ও রাষ্ট্রাদর্শ ও সাহিত্যকে প্রভাবিত করে । যেভাবেই হোক সাহিত্য একাধারে প্রেরণার উৎস এবং জীবনবোধের মুকুর স্বরূপ হয়ে থাকে ।
যদি তাই হয় তবে স্বীকার করতে হয় যে তাঁর সময়ে সাহিত্যের সাধনা দুটো স্পষ্ট ধারা প্রবাহিত হচ্ছিল । একটি ইসলাম মুখী ধারা অন্যটি ইউরোপীয় ইসম ” অনুপ সাধনা ।
তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন এবং সত্যকে স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ ছিলো না । তাই তিনি একটি অভিভাষনে বলেন - যদিও আমরা মুখে ইসলাম প্রীতি জাহির করিতেছি , কার্যতঃ তাহার যেন আশানুরূপ প্রতিফলন হইতেছে না । অপর ধারাটি (ইসম /ইউরোপীয় ধারা ) তরুণ - মন আচ্ছন্ন করিয়া আছে । ”
আধুনিক সাহিত্য কেমন হতে পারে , কি রকম হওয়া উচিত এই প্রসংগে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতামত প্রণিধানযোগ্য । তাঁর মতে সাহিত্য দু’প্রকার । একটি হলো বাস্তব ঘেঁষা অন্যটি হলো বাস্তব নিরপেক্ষ সৌন্দর্য সৃষ্টি । বাস্তব নিরপেক্ষ অর্থে প্রত্যক্ষ বাস্তবতার অভাব বোঝানো হয়েছে । এই ধরণের সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করে গেছেন ।
বাস্তব ঘেঁষা সাহিত্য যদিও তৎকালে রচিত হওয়া শুরু হয়েছিলো । বাংলা সাহিত্যে এটি ইউরোপীয় প্রভাবের ফল । নিছক বাস্তবতা ভিত্তিক সাহিত্য রচিত হতে পারে কিনা এধরনের প্রশ্ন আসতে পারে কিন্তু এটি যদি প্রতিভাবান লেখকের হাতে পড়ে , ভাবুক ও চিন্তাশীল এবং কল্পনা প্রবণ সাহিত্যিক হন তবে রচনা বাস্তবাতিরিক্ত রসে রসায়িত হয়ে এক অপরূপ রস মন্ডিত সাহিত্যের সৃষ্টি হতে পারে । এই ধরণের সাহিত্যিকের কথা যদি বলতে হয় তবে শরতচন্দ্রের নাম আসতে পারে । আর নিছক বাস্তবতা যদি সাহিত্য হয় তবে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্য , ব্যবস্থা পরিষদের প্রশ্নোত্তর , সংবাদ পত্রে প্রকাশিত নানা ঘটনা সাহিত্য হতে পারতো ।
তাই তাঁর মত - বাস্তব কাহিনী হলেই যে সাহিত্য হবে তা নয় , সাহিত্য হয়ে ওঠবার জন্য চাই সহানুভূতি , রসানুভূতি ও কল্পনা রসের অফুরন্ত প্রেরণা ।
তাঁর আলোচনা থেকে এই কথা পরিষ্কার যে - অতীতের গর্ভে নিহিত সকল উজ্জ্বল উপাদান সমূহ পাথেয় করে ভবিষ্যতের পথে যাত্রা করতে হবে । তাঁর ঐতিহ্য চেতনায় - অতীতের প্রতি কোনো মোহ নেই ” অতীতের মোহকে কাটিয়ে অতীতের সাথে ভবিষ্যতের যোগসূত্র রচনা করে , বৃহত্তর জনতার বাস্তব জীবনকে ভালোবেসে সমস্ত বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানবতার পূজারী শিল্পী সাহিত্যিকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমবেত প্রয়াস ও প্রচেষ্টা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে নয়া শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ।
তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে ” আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ স্মারক গ্রন্থ (১৯৬৯) । ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় এশিয়াটক সোসাইটির স্মারক গ্রন্থ । এরপর কোলকাতা থেকে সাহিত্যবিশারদের উপর লিখিত আজহার উদ্দিন খানের ” মাঘ নিশীথের কোকিল ”
প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে । ১৯৮৭ সালে ” আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ” নামে জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয় যেটির লেখক ছিলেন আহমেদ শরীফ । ভূঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের নির্বাচিত রচনা” আবদুল করিম প্রণীত ’’
আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ : জীবন ও কর্ম এবং ফরহাদ্ খান ও সৈয়দুর রহমান সম্পাদিত সাহিত্য বিশারদকে নিবেদিত প্রবন্ধ সংকলন ” এই তিনটি বই ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে একসাথে প্রকাশিত হয়। যে সমাজের মুক্তি এবং অন্ধত্ব মোচনকল্পে তিনি আজীবন সাধনায় ব্রতী ছিলেন সেই সমাজ তাঁর কাজ, সাহিত্যে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে সেটি অত্যন্ত গৌরবের ব্যাপার। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান এবং আজীবন সাহিত্য সাধনায় ব্রতী থাকার জন্য তাঁকে স্বাধীনতা দিবস পুরষ্কার ঘোষণা করে সম্মান প্রদান করে। লেখক: নাজমুন নাহার, কবি ও প্রফেসর
০২ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন