সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০১:৫৮:২২

শতবর্ষ আগের কোরবানি ও বর্তমানের ঈদ

শতবর্ষ আগের কোরবানি ও বর্তমানের ঈদ

মো: জোবায়ের আলী জুয়েল: মুসলমান জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ দু’টি ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। উনিশ শতকের শুরু থেকে যখন রাজনৈতিকভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে ঈদ। এক শ’ বছর আগে বাংলাদেশে কিভাবে কোরবানির ঈদ পালন করা হতো তারই কিঞ্চিৎ বর্ণনা তুলে ধরার চেষ্টা করব। আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দের সাথে ধুমধামের সাথে ঈদুল আজহা উদযাপন করি তা মাত্র ষাট-সত্তর বছরের ঐতিহ্যমাত্র।

মুসলমানরা কেন কোরবানি দেয় এবং তাৎপর্য ও উৎসই বা কী? পবিত্র কুরআনের সূরা সাফফাতে বলা হয়েছে, যখন পিতার সঙ্গে (ইবরাহিম আ:) কাজ করার মতো বয়স হলো তখন তাঁর পিতা ইবরাহিম আ: বললেন, হে প্রাণাধিক পুত্র, আমি স্বপ্নে আল্লাহর নির্দেশ পেয়েছি অর্থ প্রিয় বস্তুকে (ইসমাইলকে) জবাই করতে। এতে তোমার কি কিছু বলার আছে? ইসমাইল বললেন, হে আমার পিতা, আপনাকে আল্লাহর নিকট থেকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। যখন তাঁরা পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করলো ও ইবরাহিম আ: যখন তাঁর পুত্রকে আল্লাহর নির্দেশ মতো জবাই করার জন্য কাত করে শুইয়ে দিলেন তখন স্বয়ং আল্লাহ তাঁকে (ইবরাহিম) ডেকে বললেন, হে ইবরাহিম! তুমি তোমার প্রভুর স্বপ্নের আদেশ পালন করেছ। আমি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট। এটা ছিল ঈমানের এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাঁকে ছাড়িয়ে নিলাম এক পশু কোরবানির বিনিময়ে।

আরো বলা হয়েছে সূরা হজে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম ওয়াজিব করে দিয়েছি যাতে তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী হালাল চতুষ্পদ পশু আল্লাহর নামে জবাই করতে পার। আবার এটাও তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আল্লাহর কাছে ওদের (পশুর) গোশত, রক্ত পৌঁছে না। বরং তোমাদের নিয়ত ও ধর্মনিষ্ঠা পৌঁছায়।
ঈদুল আজহা বা ঈদ উজ জোহা মুসলিম সম্প্রদায়ে কোরবানির ঈদ, বকরি ঈদ নামেই সমধিক পরিচিত।
এক শ’ বা দেড় শ’ বছর আগে বাংলাদেশে গরু কোরবানি দেয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কোরবানি যদি কেউ দিতেন তাহলে খাসি বা ছাগলই দিতেন। ‘বাকারা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো গাভী। এ আরবি শব্দের বিকৃত রূপ নিয়েছে বকরি; কিন্তু সে সময়ে গরু যেহেতু কোরবানি দেয়া সম্ভবপর ছিল না, কোরবানি দেয়া হতো ছাগল, তাই বকরি মানে দাঁড়িয়ে গেছে ছাগল।

বিখ্যাত সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদ তার আত্মজীবনীতে সে সময়ে ঈদ উজ জোহা সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন, ‘বকরা ঈদে কেউ গরু কোরবানী করিত না। সে আমলে পরাক্রমশালী জমিদারদের তরফ থেকে গরু কোরবানী কড়াকড়িভাবে সর্বত্রই নিষিদ্ধ ছিল। শুধুমাত্র বকরী কোরবানী করা চলিত। লোকেরা করিতও প্রচুর।’

মোগল যুগে বাংলাদেশে ঈদুল আজহা কিভাবে পালন করা হতো তা জানা যায়নি। এমনকি উনিশ শতকের প্রারম্ভে ঈদুল আজহার তেমন কোনো বিবরণ আমরা পাই না।

এক শ’ দেড় শ’ বছর আগে ঈদ মুসলমানদের প্রধান উৎসব হিসেবে তেমনভাবে পালিত না হওয়ার মূল কারণ ছিল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়া এবং দারিদ্র্যের কারণে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আশা-আকাক্সার স্ফুরণ না ঘটা। আবুল মনসুর আহমেদ তার আত্মজীবনী গ্রন্থে আরো জানিয়েছেন, ‘দুটি ঈদেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মাঠে গিয়ে নামাজ পড়া এবং তারপর আত্মীয়-স্বজন নিয়ে উৎকৃষ্ট আহার করা। মহরম পর্বে আমাদের বাড়িতে এতো ধুমধাম হলেও দুই ঈদে তেমন কোন উৎসব পালন করা হতো না।’ বকরী ঈদে প্রথম প্রথম দুই, তিনটা ও পরে মাত্র একটা গরু কোরবানী হতো। এটি ছিল উনিশ শতকের প্রারম্ভের কথা। সেকালে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল সাধারণ মানুষ। এ অবস্থার পরিবর্তন এনেছিল ফরায়েজি আন্দোলন। এর আগে ইসলাম ধর্মে লোকজ উপাদানের আধিপত্য ছিল বেশি।

আশি-নব্বই বছর আগেও এই বাংলায় কোরবানি নিয়ে লোকের মধ্যে তেমন মাথাব্যথা ছিল না। মুসলমান ধর্মে কোরবানির (গরু) বিধান আছে; কিন্তু গোঁড়ামি, কুসংস্কারের কারণে তা হতো না। তা ছাড়া সে আমলে হিন্দু জমিদারদের দাপটে স্বভাবতই বাংলাদেশে গুরু কোরবানি দেয়া ছিল প্রায় অসম্ভব; কিন্তু এ অবস্থা বেশি দিন চলেনি। ফরায়েজি আন্দোলন, তিতুমীরের আন্দোলন, ধর্মীয় প্রচারকদের প্রচার, ওয়াজ মাহফিল, আঞ্জুমানের কার্যকলাপের ফলে এ ধরনের অনেক প্রথা বিলুপ্ত হয়েছিল।

আজকে আমরা বাংলাদেশে অনায়াসে গরু বা ছাগল কিনে সহজেই কোরবানি করি। সত্তর-আশি বছর আগেও তা এত সহজ ছিল না। এর জন্য সে সময় সারা বাংলায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের রীতিমতো আন্দোলন করতে হয়েছে। আজকের প্রজন্ম হয়তো অবাক হবে এটা জেনে, এ নিয়ে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর সারা বাংলায় বিতর্ক চলেছে এবং কোরবানি বিশেষ করে গরু কোরবানি দেয়ার অধিকার আমাদের পিতা ও পিতামহদের হিন্দুদের সাথে লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে। হিন্দুরা তো বটেই অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদেরও সংস্কার ছিল গরু জবাইয়ের বিপক্ষে। সে সময় হিন্দু জমিদারদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। সম্প্রদায়গত মান-অভিমানের ব্যাপারটিও ছিল যুক্ত, ফলে বিষয়টি নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল এবং এ বিতর্ক বিভিন্ন সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে পড়েছিল।

১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী ‘গো-হত্যা নিবারণী’ সভা শুরু করে, এর বিপক্ষে ভারতবর্ষজুড়ে চালিয়েছিলেন প্রবল প্রচার। ১৮৮৭ সালে রাজশাহীর তাহিরপুরের জমিদার শশিশেখর রায় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে গরু কোরবানির বিপক্ষে উত্থাপন করেছিলেন প্রস্তাব। ফরিদপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয়েছিল এর বিপক্ষে প্রচার। হিন্দু জমিদাররা এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সভা ও আঞ্জুমান এগিয়ে এসেছিল এর প্রতিবাদে। একজন মুসলমান সমাজসংস্কারক সে সময় লিপিবদ্ধ করেছিলেন মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র। তিনি লিখেছিলেন ‘গোবিন্দপুর, হরিশঙ্করপুর, সনাতনী, গোপিনগর সর্বত্রই হিন্দু জমিদারদের দোর্দণ্ড প্রতাপে সেখানকার মুসলমানরা বহুকাল অবধি গরু কোরবানি করতে বা গরু জবাই ও এর গোশত খেতে পারত না। কেউ তা করলে জমিদার কাচারির দোর্দণ্ড হিন্দু নায়েবরা তাদের ধরে এনে চাবুকের কশাঘাতে জর্জরিত করত। হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারে ওই অঞ্চলগুলোতে গরু কোরবানি প্রথা উঠিয়া গিয়েছিল।’

১৮৯৬ সালে ময়মনসিংহের অম্বরিয়া, মুক্তাগাছা ও সন্তোষের জমিদাররা গরু কোরবানির জন্য তাদের গ্রামের বেশ কিছু মুসলমানকে জরিমানা করেছিলেন। ১৯০৫ সালে বৃহত্তর কুমিল্লার চাঁদপুরে কয়েকজন মুসলমান গরু কোরবানি দেয়ায় প্রভাবশালী গোপালচন্দ্র মজুমদার তাদের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করেছিলেন। অভিযোগ ছিল, মুসলমানরা প্রকাশ্যে ‘মাংস ধুয়ে জল অপবিত্র করছে।’ সে সময়ে জেলা হাকিম ছিলেন জগদীশচন্দ্র সেন। তিনি বিচারে তিনজন মুসলমানের একজনকে এক মাসের কারাদণ্ড এবং অপর দু’জনকে পঞ্চাশ ও ষাট টাকা জরিমানা করেছিলেন (ওয়াকিল আহমদের কোরবানিবিষয়ক গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৪২)।
উনিশ শতকের শেষার্ধে কোরবানি বিশেষ করে গরু জবাই বিতর্কে ভিন্নমাত্রা সংযোজিত হলো যখন প্রখ্যাত মুসলিম সাহিত্যিক বিষাদসিন্ধু রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন গরু কোরবানির বিপক্ষে অবস্থান নিলেন। তৎকালীন আখবারে এসলামিয়া সম্পাদক মৌলভি নঈমুদ্দীন এরই বিতর্কে মুসলমানদের পক্ষাবলম্বন করেন। মীর মশাররফ হোসেনের যুক্তি ছিল, গরু জবাই বা গরু কোরবানি দুই ধর্মের সম্প্রীতির পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিনি তৎকালীন আহমদিতে লিখেছিলেন, ‘গোকুল নির্মূল আশঙ্কা’ নামে একটি প্রবন্ধ। পরে এ বিষয়ে তিনি আরো দু’টি প্রবন্ধ ‘গো-ধন কি সামান্য ধন’ ও ‘গো মাংস ও গো দুগ্ধ’ লিখেছিলেন। এই প্রবন্ধগুলোর একত্র করে তিনি তার গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন ‘গো জীবন’ (১৮৮৯ খ্রি.)।

গরু কোরবানি ও গরুর গোশত ভক্ষণের পক্ষে এগিয়ে এসেছিলেন মৌলভি মঈনুদ্দীন। তিনি ছিলেন টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত মাসিক আখবার এসলামিয়ার সম্পাদক (১৮৮৮ খ্রি.)। আখবার ও মঈনুদ্দীনের পক্ষে ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এগিয়ে এসেছিলেন ঢাকার জগন্নাথ, জুবিলি ও নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা। ঢাকায় ছাত্ররা গরু কোরবানির পক্ষে আয়োজন করে বিরাট সভার। দু’পক্ষের ভুল বোঝাবুঝির প্রেক্ষাপটে আলেমদের সমঝোতায় মামলায় আপসরফা হয়েছিল।

১৯১০ সালের সংবাদে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশে গরু কোরবানিতে বাধা দিচ্ছেন স্থানীয় হিন্দু জমিদাররা। তৎকালীন মাসিক বাসনা (১৯০৮ খ্রি.) লিখেছিলেন, “অনেক জমিদার কোলকাতার ‘গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে’ খানা খাইতে পারেন কিন্তু আপন জমিদারীর মধ্যে মুসলমান প্রজাদের ধর্মকর্ম (কোরবানি) করতে দেন না। যত দিন হিন্দু জমিদাররা প্রকাশ্য মুসলমানদের ধর্মকর্মে কোরবানিতে বাধা দেবে তত দিন কোনো ঐক্য হবে না।” এভাবেই তৎকালীন মুসলমান সমাজকে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে সংগ্রাম করে গরু কোরবানিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে। বিত্তবান ও বিত্তহীনদের তফাৎ চোখে লাগার মতো প্রকট হয়ে উঠেছে। কোরবানি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সামাজিক মর্যাদাসূচক প্রতীক হিসেবে।

মোগল আমলের ইতিহাসে আমরা দেখেছি বিত্তবানরা ঈদের দিন ছুড়ে দিচ্ছে রেজগি পয়সা আর সাধারণ নিরন্ন বঞ্চিত মানুষ তা কুড়িয়ে নিচ্ছে কাড়াকাড়ি করে। এ আমলেও কোনো হেরফের হয়নি বরং বঞ্চনা আরো বেড়েছে। আমরা দেখছি কোরবানির গোশত নেয়ার জন্য লুটোপুটি। তা আমাদের হতভাগ্য, বঞ্চিত, দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের চেহারাই তুলে ধরে।

ঈদুল আজহা আমাদের জীবনে বয়ে নিয়ে আসুক অনাবিল প্রীতি, আনন্দ, ভ্রাতৃত্ববোধ ও আত্মত্যাগে সমৃদ্ধ মহিমান্বিত গৌরবদীপ্ত জীবন।-নয়া দিগন্ত
লেখক : গবেষক
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে