শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ০২:০৬:১৯

কাঁদছে মানবতা, নিজ ঘরে পরবাসী মায়ানমারের মুসলমানরা

কাঁদছে মানবতা, নিজ ঘরে পরবাসী মায়ানমারের মুসলমানরা

আল আমিন আশরাফি: অহিংসা পরম ধর্ম’, ‘জীব হত্যা মহাপাপ’—এসব নীতিকথা বলেছেন গৌতম বুদ্ধ। মানবতাবাদী হিসেবে জগৎসংসারে তিনি বেশ খ্যাতিও কুড়িয়েছেন। প্রবর্তন করেছেন বৌদ্ধ ধর্মের। এ ধর্মের অনুসরণ করে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের বেশির ভাগ মানুষ। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি মিয়ানমারে? এটা কোন ধরনের অহিংসার নমুনা! তাহলে কি মিয়ানমারের লোকদের কাছে মুসলমানরা ‘জীব’-এর সংজ্ঞায় পড়ে না?

‘জীব হত্যা মহাপাপ’-এর অমর বাণীর পতাকাবাহী বৌদ্ধদের হাতে বছরের পর বছর ধরে খুন হচ্ছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান। তাদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে আরাকানের সবুজ ঘাস, রক্তে জমাট হয়েছে মাটি। নারী-পুরুষের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছে মিয়ানমারের আকাশ-বাতাস। এই তো সেদিন—গত ১৪ নভেম্বর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের গ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিতে ৩০ ব্যক্তি নিহত হয়েছে। হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের গ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ করার ঘটনা স্বীকার করেছে দেশটির সরকার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বরের মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় মংদা ও জেলার তিনটি গ্রামের ৪৩০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

শত শত বছর ধরে মিয়ানমারের লোকেরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করে যাচ্ছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন ‘শান্তিকন্যা’ অং সান সু চি। বিবিসি বাংলা বলছে, মিয়ানমারের সৈন্যরা দুটি হেলিকপ্টারযোগে রোহিঙ্গা মুসলমানদের গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালায়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলছেন, নতুন প্রকাশিত ছবিতে ব্যাপক হারে ধ্বংসযজ্ঞ দেখা যাচ্ছে, যা আগের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমারের ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার মুসলিম নিধনের এ কর্মযজ্ঞকে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ হিসেবে অভিহিত করছে।

জেনে নিই রোহিঙ্গা কারা?

রোহিঙ্গারা পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। এদের বেশির ভাগই মুসলমান। রাখাইন স্টেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হলো রোহিঙ্গা। সংখ্যায় প্রায় ২০ লাখ রোহিঙ্গার বেশির ভাগ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পাশে পূর্ববর্তী আরাকান রাজ্যের তিনটি টাউনশিপে বাস করে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও উগ্র রাখাইনদের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও এথনিক ক্লিনজিংয়ের শিকার হয়ে প্রায় ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তী সময়ে চাটগাঁইয়া, রাখাইন, আরাকানি, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মিশ্রণে এই জাতি এয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

 

ইসলাম, রাখাইন ও আরাকান

রোহিঙ্গা ইতিহাসবিদদের মতে, আরবি শব্দ ‘রহম’ (দয়া করা) থেকে রোহিঙ্গা শব্দের উদ্ভব। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আরবের বাণিজ্য জাহাজ রামব্রি দ্বীপের তীরে এক সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে। জাহাজের আরবীয় মুসলমানরা ভাসতে ভাসতে কূলে ভিড়লে ‘রহম’ ‘রহম’ ধ্বনি দিয়ে স্থানীয় জনগণের সাহায্য কামনা করতে থাকে। রহম শব্দই বিকৃত হয়ে রোয়াং হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা মনে করে থাকেন। অনেকেই মনে করেন, এরা রহম জাতির লোক। জাপানের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক Kei Nemote রোহিঙ্গা ইতিহাসবিদদের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন, রোহিঙ্গারা অষ্টম শতাব্দী থেকে রাখাইন রাজ্যে বাস করে আসছে। একজন ইসরায়েলি লেখক Moshe Yegar তাঁর  ‘Between Integration and Secession : The Muslim Communities of the Southern Philippines, Southern Thailand and Western Burma/Myanmar’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মুসলমানরা বার্মায় তাদের বসতি স্থাপনের প্রথম থেকেই রাজকীয় উপদেষ্টা, প্রশাসক, বন্দর কর্তৃপক্ষ, মেয়র, স্থানীয় চিকিৎসকসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে।

আরাকানের মুসলিম ঐতিহ্যের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সর্বপ্রথম হজরত আবু ওয়াক্কাস ইবনে ওয়াইব (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় (৬১৭-৬২৭ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে) আরাকান অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসেন। ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের (রহ.)-এর শাসনামলে আরাকানের শাসকদের সঙ্গে আরবীয় মুসলমানদের যোগাযোগের বিষয়টিও প্রমাণিত। তবে দশম ও একাদশ শতাব্দীতে আরব বণিক ও সুফি-সাধকদের ব্যাপক আগমনের ফলে আরাকান অঞ্চলে দ্রুত ইসলামের প্রচার হতে থাকে। তাই মিয়ানমারে মুসলমানদের ইতিহাস প্রায় ১২০০ বছরের পুরনো। গত সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা বিদ্রোহীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হলে তাঁর অনুরোধে গৌড়ের সুলতান কয়েক দফায় সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ১৪৩২ সালে গৌড়ের সেনাপতি সিন্দি খান আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। ওই সময় থেকেই বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও স্বাধীন আরাকান রাজ্যের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ধীরে ধীরে আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাজসভায় বাংলা ভাষা বিশেষ স্থান লাভ করে। মহাকবি আলাওল, শাহ মুহম্মদ সগির, মাগন ঠাকুরের মতো মধ্যযুগের বিখ্যাত কবিরা আরাকান রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।

 

মানবতার হাহাকার
রোহিঙ্গারা সর্বপ্রথম জুলুমের শিকার হয় ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে। বার্মার খ্রিস্টান রাজা সে সময় আরাকান দখল করে নেন। এরপর রোহিঙ্গারা বড় ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় ১৯৪২ সালে, যখন জাপান বার্মা দখল করে নেয়। এসব নির্যাতনের সব মাত্রা ছাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর ধারাবাহিক নিপীড়ন-নির্যাতন শুরু হয় ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পর থেকে। নিপীড়ন চরম আকার ধারণ করে ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নতুন নাগরিকত্ব আইন প্রণয়নের ফলে। এ আইন কার্যকর হওয়ার পর বাতিল হয়ে যায় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব। তখন থেকে মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারও অচল হয়ে পড়ে।

১৯৪২ সালে জাপান বার্মা দখল করার পর স্থানীয় মগরা জাপানি সৈন্যদের সহায়তা নিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ইতিহাসে এটি ১৯৪২ সালের গণহত্যা নামে খ্যাত। তখন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয় এবং পাঁচ লক্ষাধিক বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। ব্রিটিশরা বার্মা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় এমন এক নীতি চাপিয়ে দিয়ে যায়, যার ফলে আরাকানের মুসলমানরা উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়।

স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৪৭ সালের শাসনতান্ত্রিক নির্বাচনে ইংরেজদের দেওয়া ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ অভিধার কারণে মুসলমানদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। উ ন নামক শাসক আরাকান থেকে মুসলমানদের বিতাড়নের উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালে মগ সেনাদের নিয়ে Burma Territorial Force গঠন করে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। পরিকল্পিতভাবে মুসলিম বুদ্ধিজীবী, গ্রামপ্রধান, আলেম-ওলামা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আর সেখানে মগদের জন্য বসতি নির্মাণ করা হয়। ১৯৬২ সালের ২ মার্চ উ নকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের পর নে উইন সংখ্যালঘুদের সব সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে দেন। ১৯৬৪ সালে রোহিঙ্গাদের সব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয় এবং ১৯৬৫ সালের অক্টোবর থেকে Burma Broadcasting Service থেকে প্রচারিত রোহিঙ্গা ভাষার সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বার্মা সরকার ১৯৭৩ সালে উত্তর আরাকানে Major Aung Than operation ও ১৯৭৪ সালে Sabe operation নামে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান চালায়। ফলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবন রক্ষার্থে যুদ্ধবিধ্বস্ত দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশে এসে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে। সেবারে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় অবস্থান ও চরমপত্রের কারণে বার্মা সরকার বিতাড়িতদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। তারপর তিন বছর যেতে না যেতেই সামরিক জান্তা ‘কিং ড্রাগন অপারেশন’ নামে রোহিঙ্গা উচ্ছেদে ভয়াবহ অভিযান শুরু করে। এরপর সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৯০ এবং ২০১২ সালে রোহিঙ্গা উচ্ছেদে বর্বরতম অভিযান পরিচালনা করে বার্মার সামরিক জান্তা। শতাব্দীকাল ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চলা নির্মম নির্যাতনের বিষয়টি এখন সমগ্র বিশ্বের সামনে পরিষ্কার এবং এটাও স্পষ্ট যে শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই তাদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হচ্ছে।

জেনারেল নে উইন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সব মিয়ানমার সরকারই মৌলিক মানবাধিকার বন্ধ রেখে রোহিঙ্গাদের সার্বিক বিনাশের খেলায় মত্ত। রোহিঙ্গারা পৃথিবীর অন্যতম রাষ্ট্রবিহীন মানুষ। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রবিহীন ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে করা সব ধরনের অপরাধকে বৈধতা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের কোনো অনুচ্ছেদই সেখানে মানা হচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা হলো—নাগরিকত্ব অস্বীকার, সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত ভ্রমণ ও চলাচল, নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত শিক্ষা, সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত কাজের অধিকার, জবরদস্তিমূলক শ্রমনিয়োগ, ভূমি অধিগ্রহণ, জবরদস্তিমূলক উচ্ছেদ, ঘরবাড়ি, অফিস, স্কুল, মসজিদ ইত্যাদি ধ্বংস, জাতিগত বৈষম্যমূলক আচরণ, নিয়ন্ত্রিত বিয়ে, সন্তান গ্রহণে বাধা ও জোরপূর্বক গর্ভনাশ, স্বেচ্ছাচারী কর আরোপ, গবাদি পশুসহ পরিবারের সদস্যদের জবরদস্তিমূলক জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধীকরণ, আইনবহির্ভূতভাবে হত্যা, রোহিঙ্গা নারী ও বয়স্কদের অবমাননা ও অমর্যাদা, যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে অভিবাসন ও নাগরিকত্ব কার্ড বাজেয়াপ্তকরণ, অভ্যন্তরীণ শরণার্থী ও রাষ্ট্রহীনতা, মুসলিম ঐতিহ্যসমৃদ্ধ স্থান ও প্রতীকের ধ্বংস কিংবা পরিবর্তন ইত্যাদি।

জাতিসংঘসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গাদের ব্যপারে এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী, কিন্তু এ ব্যাপারে তারা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
লেখক : ইতিহাস গবেষক ।-কালের কন্ঠ           
১৯ নভেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে