শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:০৮:১০

মহানবী (স:) ছিলেন গোটা মানবজাতির জন্য রহমতের সাগরতুল্য

মহানবী (স:) ছিলেন গোটা মানবজাতির জন্য রহমতের সাগরতুল্য

কবির আহমাদ আশরাফী, ঢাকা: সর্বশ্রেষ্ঠ মানব এমনকি নবীকুলের মধ্যেও সর্বশ্রেষ্ঠ রসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (স) এর জন্ম হয়েছে রবীউল আউয়াল মাসে। মৃত্যুও হয়েছে এ মাসেই। তিনি ছিলেন এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল গুরুত্বপূর্ণ সব গুণাগুণ-সকল চরিত্র। এককথায় তিনি সৃষ্টিকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ। ইমাম নববী (র) ‘তাহযীব’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আখলাক ও চরিত্রের সকল উত্তম গুণাগুণ রসূলুল্লাহ (স) এর মধ্যে একত্রিত করে দিয়েছেন।” মুহাম্মাদ (স) ছিলেন- ইয়াতীমের আশ্রয়দাতা ও অসহায়দের সহায়দাতা।

তিনি স্বয়ং নিজে দুর্বল, গরীব ও দুঃস্থ-দরিদ্রদের দ্বারে দ্বারে যেতেন। স্বহস্তে তাদের কাজকর্ম করে দিতেন। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তিনি দুঃস্থ-দরিদ্রদের এতো বেশি মূল্যায়ন করতেন যে, তাদের দাওয়াত অবশ্যই গ্রহণ করতেন এবং তাদের জানাজায় অবশ্যই শরীক হতেন। তিনি ছিলেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকারী ও নারীর অধিকার রক্ষাকারী। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন শ্রমিকদের দরদী নেতা। তিনি মালিকদের নির্দেশ করেছেন যে, ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকদের পারিশ্রমিক প্রদান করো। যথাসম্ভব তাদের কাজের চাপ কমিয়ে দাও আর পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দাও। ক্রীতদাসের অধিকার প্রতিষ্ঠাকারীও তিনি। ক্রীতদাস প্রথা পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল। রসূলুল্লাহ (স) অস্থায়ী জেলকোড হিসেবে এটি চালু রেখেছিলেন।

এজন্যই ক্রীতদাস মুক্তির বহু ফজিলত তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, তোমরা মালিকরা যা খাবে ক্রীতদাসকে তাই খাওয়াবে। তোমরা যা পরিধান করবে তাকেও তাই পরিধান করাবে। বহু যুদ্ধ কোনো রক্তপাত ছাড়াই তিনি বিজয় লাভ করেছেন। এমনকি মহান মক্কা বিজয় দিবসেও কোনো রক্তপাত হয়নি। কারণ, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং উদ্দেশ্য ছিল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, দ্বীনকে সমুন্নত করা। তিনি ছিলেন সাধারণ ক্ষমার প্রতীক। তিনি কখনোই ব্যক্তি স্বার্থের জন্য প্রতিশোধ নেননি। কাফের-মুশরিকদের পক্ষ থেকে সহস্র ধরনের কষ্ট পেয়েও তাদের প্রতি দয়া দেখিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের দিন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে এক বিরল নিদর্শন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে শরীআতের সীমা লঙ্ঘনকারী থেকে আল্লাহর জন্য প্রতিশোধ নিয়েছেন।

রসূলুল্লাহ (স) ছিলেন গোটা মানবজাতির জন্য রহমতের সাগরতুল্য। তাই যুদ্ধের আগেই যুদ্ধাপরাধের দ্বার বন্ধ করে দিলেন তিনি। আদেশ করলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে তোমরা শিশু, নারী, বৃদ্ধ, অসুস্থ ব্যক্তি ও সন্ন্যাসী-পুরোহিতদের হত্যা করবে না। আত্মসমর্পণকারী ও পলায়নকারীকে হত্যা করবে না। কারাবন্দীদের খাদ্য প্রদান করবে। খাওয়ার প্রয়োজন ব্যতীত কোনো পশু নিধন করবে না। ফলদার গাছ কাটবে না। বাড়ি-ঘর ও উপাসনালয় ধ্বংস করবে না ইত্যাদি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জান-মাল-সম্মান রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করেছেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ বিচারক। তাঁর ন্যায় বিচার ছিল সকলের জন্য উন্মুক্ত। বিচার কার্যে মুসলিম-অমুসলিম, ধনী-গরীব, আত্মীয়-অনাত্মীয়র মাঝে কোনো পার্থক্য করেননি।

তাঁর এরূপ ন্যায় বিচার দেখে বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছেন। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি ব্যবসা করেছেন। ব্যবসায় সততা ও নিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সত্ ব্যবসায়ীর হাসর হবে নবীগণের সঙ্গে। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই পণ্যের মূল্য নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। বরং ভ্রাতৃত্বের মনোভাব সামনে রেখে বিক্রেতাকে কিছু মূল্য ছেড়ে দিতে আর ক্রেতাকে কিছু মূল্য বাড়িয়ে দিতে বলেছেন।  তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী ও সুবক্তা। মুচকি হাসি ও হাস্যমুখে কথা বলতেন। তাঁর শব্দ ও বাক্যগুলো হতো খুবই স্পষ্ট। হযরত আয়েশা (র) বলেন, রসূল (স) অতি দ্রুত কথা বলতেন না। বরং এমন স্থীরভাবে কথা বলতেন যে, কেউ চাইলে শব্দগুলোও গণনা করতে পারত। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ পতি।

এগারোজন স্ত্রীর স্বামী। সাধারণ মানুষ তো একজন স্ত্রীর হক আদায় করতেই ব্যর্থ। তবে রসূল (স) এরূপ নমুনা পেশ করেছেন যে, স্বামীর কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা বা কমতির অভিযোগ কোনো স্ত্রীরই ছিল না। তিনি স্ত্রীগণের ভরণ-পোষণের উপকরণ বছরের শুরুতে একত্রে প্রদান করতেন। সাংসারিক কাজকর্মে স্ত্রীদের সহযোগিতা করতেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ পিতা। তিনি বলেছেন, পিতা-মাতার উপর সন্তানের তিনটি হক রয়েছে: জন্মের পর তার সুন্দর নাম রাখা, তাকে দ্বীনী শিক্ষা দেওয়া এবং প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে বিয়ে দেওয়া। সকল পিতা-মাতা যদি তাদের এ দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে আমাদের সমাজ রূপান্তর হবে আদর্শ ও সোনালী সমাজে। তিনি ছিলেন ধৈর্যশীল ও ক্ষমাশীল।

রাগের সময়ও অস্থির-অসহিষ্ণু হতেন না। খারাপ ব্যবহারের প্রতিউত্তরে ভালো ব্যবহার করতেন। গালির উত্তরেও গালি দিতেন না। অভিশাপ দিতেন না। বদদুআ করতেন না। ব্যক্তি স্বার্থের জন্য কখনো কোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ নেননি। জিহাদ ব্যতীত কখনো কাউকে মারেননি। এমনকি কোনো খাদেম বা স্ত্রীকেও নয়। প্রত্যেক মুহূর্তই তিনি আল্লাহ তা‘আলার জিকিরে মগ্ন থাকতেন। কোনো প্রকারের কাজ বা ব্যস্ততা তাঁকে জিকির থেকে বিরত রাখতে পারেনি। চুপ থাকলেও মনে মনে জিকির করতেন। তাঁর প্রতিটি কথা হতো আল্লাহর জিকির। আল্লাহর প্রসংশা-পবিত্রতা বর্ণনা। তাসবীহ-তাকবীর-তাহলীল ইত্যাদি। খাওয়া-দাওয়া, উঠাবসা, হাঁটাচলা, ভ্রমণসহ তাঁর কোনো কাজই জিকির থেকে খালি হতো না।

যখন তিনি মানুষদের দ্বীনের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করলেন, তখন পুরো জাতি তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়। তবুও কোনো কাফের-মুশরিক তাঁর সততা ও সত্যবাদী হওয়ায় সন্দেহ পোষণ করতে পারেনি। বরং তাঁকে সবচেয়ে বেশি আমানতদার হিসেবে বিশ্বাস করত এবং তাঁর কাছে টাকা-পয়সা গচ্ছিত রাখত। তিনি কখনোই শক্ত ভাষায় কথা বলতেন না। উগ্র মেজাজের ছিলেন না। রাগের চেয়ে তাঁর ধৈর্য-সৈহ্য ছিল বেশি। অহংকারী ছিলেন না (এমনকি তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়াতে নিষেধ করতেন। কথার মাঝখানে কাউকে থামাতেন না। মুচকি হাঁসি ও রসিকতায় সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। হযরত আনাস (র) বলেন, আমি আট বছর বয়সে রসূলুল্লাহ (স) এর খেদমতে এসেছি। দীর্ঘ দশ বছর তাঁর সেবায় ছিলাম। বয়স ছিল কম, তাই ভুল করতাম বেশি। কিন্তু তিনি কখনোই তিরস্কার করেননি। এমনকি তাঁর পরিবারের কেউ নিন্দা করলে তিনি নিষেধ করতেন।

মানুষের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি দানশীল। জীবন যাপন করেছেন দুস্থ-দরিদ্রের মতো। কিন্তু দানশীল ছিলেন রাজা-বাদশাদের চেয়েও বেশি। একবার অতি প্রয়োজনের সময় এক মহিলা একটি চাদর উপহার দিল। প্রয়োজনের খাতিরে তিনি তা পরিধান করলেন। তখন অন্য এক ব্যক্তি চাদরটি চেয়ে বসল। নিজের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তিনি সঙ্গে সঙ্গেই দান করে দিলেন।

এক কথায় তিনিই সৃষ্টির সেরা। সৃষ্টিকুলের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ, সর্বোত্তম নমুনা। সুতরাং জীবনের সকল ক্ষেত্রে একমাত্র তাঁকেই অনুসরণ করা শ্রেয়। তাইতো বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও রসূলুল্লাহ (স) এর উত্তম আদর্শের কথা স্বীকার করে বলেন, “ভারতবর্ষে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এজন্য ব্যর্থ হয়েছিল যে, এর পশ্চাত্পটে (মুহাম্মাদ সা. এর মতো) কোনো মহান ব্যক্তিত্ব কিংবা প্র্যাকটিকাল জীবন ছিল না, যা আমাদের জন্য আদর্শ (অনুসরণীয়-Ideal) হতো।” (খুতবাতে মাদরাস, পৃ. ২৮, সাইয়েদ সুলাইমান নদবী)-ইসলামী অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও গ্রন্থকার
২৫ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে