বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৫, ০৭:৩১:৫৮

কোরআন-হাদিসের আলোকে মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য

কোরআন-হাদিসের আলোকে মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য

ইসলাম ডেস্ক: অনেকেই তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। কিন্তু ইসলামে আল্লাহ পাক বাবা-মায়ের মর্যাদা অনেকে উপরে দিয়েছেন। যে বাবা-মায়ের কারণে একজন সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়, সেই বাবা মাকে যারা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে, তারা আর যাই হোক মানুষ নয়। । পবিত্র কুরআন পাকে আল্লাহ পাক তার নিজের অধিকারের পরই পিতা-মাতার অধিকারের কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। (সূরা বনী ইসরাঈল:২৩) ইমাম কুরতুবী (রাহ.) বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ পাক পিতা-মাতার সম্মান এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করাকে নিজের ইবাদতের সাথে বর্ণনা করে সন্তানের ওপর তা অপরিহার্য করেছেন। যেমন- অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক নিজের শোকরের সাথে পিতা-মাতার শোকরকে একত্রিত করে তা আদায় করা অপরিহার্য করেছেন। কুরআনে পাকে বর্ণিত হয়েছে, তোমরা আমার শুকরিয়া আদায় করো এবং পিতা-মাতারও। (সূরা লোকমান : ১৪) এতে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামে আল্লাহ পাকের ইবাদতের পর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা যেমন অতীব জরুরি অনুরূপভাবে পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় করাও সন্তানের জন্য জরুরি। (তাফসীরে কুরতুবী: ৫/৫৭৫) এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, কোন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে প্রশ্ন করলেন, আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ কোনটি? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, সময় মতো নামায পড়া। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, এরপর কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, এরপর কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। (সহীহ বুখারী: ১/৭৬) এ হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, দ্বীনের অন্যতম স্তম্ভ নামাযের পড়া আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় কাজ হলো পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। কুরআনে কারীমে এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি মানুষকে পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি।’ (সূরা লোকমান : ১৪) উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, পিতা-মাতার আনুগত্য এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা সন্তানের ওপর অপরিহার্য। তবে সন্তানের ওপর পিতা অপো মাতার অধিকার বেশি। এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) বলেন, এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমার সাহচর্যে সদ্ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি কে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার মাতা। সে আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার মাতা। সে আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার মাতা। সে আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার পিতা। অতঃপর ধারাবাহিকভাবে নিকটাত্মীয়। (সহীহ বুখারী: ২/৮৮৩) আল্লামা ইবনে কাছীর রাহ. এ হাদিস উল্লেখ করে বলেছেন, উল্লেখ করেন, এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সন্তানের ওপর মাতার অধিকার পিতার চেয়ে তিন গুণ বেশি। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সা.) মাতার কথা তিনবার উল্লেখ করেছেন, চতুর্থবারে পিতার কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া মাতার অধিকার বেশি হওয়ার স্বতন্ত্র কয়েকটি কারণ রয়েছে। এক. গর্ভধারণের কষ্ট। দুই. প্রসবকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গর্ভ প্রসবের কষ্ট । তিন. দুগ্ধপান করানো এবং সন্তানের সেবা-যতেœ নিয়োজিত থাকার কষ্ট। এসব কারণ পিতার মধ্যে বিদ্যমান নেই। (তাফসীরে কুরতুবী -৫/৫৭৫) তাছাড়া পবিত্র কুরআনে পাকে মায়ের কষ্টের এসব কারণের কথা উল্লেখ হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন, মাতা তাকে বড় কষ্টে গর্ভ ধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছে, আর তাকে গর্ভে ধারণ করা ও দুধ ছাড়ানো ত্রিশ মাস । (সূরা লোকমান :১৪) রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন হাদিস শরীফে পিতা-মাতার আনুগত্য ও সদ্ব্যবহারের অনেক ফজিলত বর্ণনা করেছেন। যেমন- হযরত আবুদ্দারদা (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি তার নিকট এসে বললেন, আমার স্ত্রীকে আমার মা তালাক দেয়ার জন্য আদেশ দিচ্ছেন, তখন আবুদ্দারদা (রাযি.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বর্ণনা করতে শুনেছি, পিতা-মাতা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা। এখন তোমাদের ইচ্ছে, এর হেফাজত করো অথবা একে বিনষ্ট করে দাও। (তিরমিযী শরীফ -২/১২) অন্য এক হাদিসে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত। (তিরমিযী শরীফ-২/১২) অন্যত্রে হযরত আবু উমামা (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তানের ওপর পিতা-মাতার দায়িত্ব কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তারা উভয়েই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ, পৃ-২৬০) এ হাদিসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের আনুগত্য ও সেবাযত্ন জান্নাতে নিয়ে যায় এবং তাদের সাথে অসৎ আচরণ ও তাদের অসন্তুষ্টি জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। অনেকে ধারণা করে থাকে, পিতা-মাতার আনুগত্য ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাদেরকে ওলীয়ে কামেল বা সৎ ব্যক্তি হতে হবে, এমন ধারণা আদৌ ঠিক নয়। এমনকি যদি কারো পিতা-মাতা অমুসলিম হয়, তাহলে তাদের সাথেও সদ্ব্যবহার করার জন্য ইসলাম জোর নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে ইমাম বুখারী (রাহ.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার নিকট আসলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার মা আমার নিকট দেখা করতে আসেন, আমি কি তার সাথে সদাচরণ করতে পারবো? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হ্যাঁ! তার সাথে সদ্ব্যবহার করো। (বুখারী শরীফ-২/৮৮৪) ইসলামে পিতা-মাতার খেদমত ও তাদের সাথে সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব এতো বেশি যে, জিহাদ ফরযে কেফায়ার স্তরে থাকা পর্যন্ত পিতা-মাতার অনুমতি ছাড়া সন্তানের জন্য জিহাদে অংশ গ্রহণ করা জায়েয নয়। বুখারী শরীফে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, একজন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, আমি জিহাদে অংশ গ্রহণ করতে চাই, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পিতা-মাতা জীবিত আছেন কী? সে বললো, হ্যাঁ! রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তাহলে তুমি পিতা-মাতার সেবাযত্নে আত্ননিয়োগ করো। (বুখারী- ২/৮৮৩) পিতা-মাতার খেদমত, আনুগত্য ও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা সর্বাবস্থায় সন্তানের ওপর ওয়াজিব। তবে যখন পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হয়, তখন তারা বেশি সন্তানের খেদমতের মুখাপেী হয়। তখন যদি সন্তানের প থেকে সামান্যও বিমুখতা প্রকাশ পায়, তা তাদের অন্তরে ত হয়ে দেখা দেয়। তাই আল্লাহ পাক কুরআন মাজিদে পিতা-মাতা বার্থক্যে উপনীত হলে, ‘তাদের সাথে কিরূপ আচরণ করণীয়, তা সম্পর্কিত কতিপয় নির্দেশনা বিশেষভাবে সন্তানদেরকে প্রদান করে বলেন, তাদের একজন বা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্থক্যে উপনীত হলে, তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমকও দিও না, তাদের সাথে সম্মান সূচক শব্দ দ্বারা কথা বলিও। তাদের সামনে ভালবাসার সাথে নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলো, হে প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা আমাকে শৈশব কালে লালন-পালন করেছেন।’ (সূরা বনী ইসরাঈল-২৩/২৪) আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ পাক সন্তানদেরকে কয়েকটি আদেশ প্রদান করেছেন, এক. পিতা-মাতাকে ‘উহ’ শব্দও বলবে না। এখানে ‘উহ’ শব্দ বলে এমন শব্দ বোঝানো হয়েছে, যা দ্বারা বিরক্তি প্রকাশ পায়। হযরত আলী (রাযি.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, পীড়া দানের েেত্র ‘উহ’ বলার চাইতেও কম কোনো স্তর থাকলে তাও অবশ্যই উল্লেখ করা হতো। সারকথা, যে কথায় পিতা- মাতার সামান্য কষ্ট হয়, তাও নিষিদ্ধ। (তাফসীরে কুরতুবী-৫/৫৭৯) দ্বিতীয়. তাদেরকে ধমক দিবে না। এটি যে বেদনাদায়ক তা সকলের কাছে স্পষ্ট। ২৯ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে