রায়হান রাশেদ : ৩৭ বছর ধরে বিনা বেতনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান দিচ্ছেন হাজি মো. হাফিজ উদ্দীন। ফজরের আজান ছুটে যাওয়ার ভয়ে কারো বাড়িতে রাত যাপন করেন না। আমৃত্যু আজান দিতে চান। তাকে নিয়ে লিখেছেন রায়হান রাশেদ
নরসিংদী সদরের মহিষাশুরার চান্দেরপাড়া গ্রামে হাজি মো. হাফিজ উদ্দীনের বাড়ি।
বয়স ৮৫ ছুঁই ছুঁই। বাড়ির পাশেই চান্দেরপাড়ের উত্তরপাড়া জামে মসজিদে বিনা বেতনে আজান দেন ৩৭ বছর ধরে। ২০০৫ সালে হজ করেছেন।
শুরুটা যেভাবে
চান্দেরপাড়ের মসজিদটি তখনও পাঞ্জেগানা। দূরের মসজিদে গিয়ে মুসল্লিরা জুমার নামাজ পড়ে আসেন। মসজিদে কোনো নিয়মিত মুয়াজ্জিন নেই। যে আগে আসেন, তিনিই আজান দেন। হাফিজ উদ্দীনও মাঝেমধ্যে আজান দিতেন।
এর মধ্যে ১৯৮৮ সালে স্থানীয় মুরব্বিদের তত্ত্বাবধানে মেঘনার পারে ওয়াকফকৃত জায়গায় নির্মাণ করা হয় চান্দেরপাড়া উত্তরপাড়া জামে মসজিদ। তখন থেকে হাফিজ উদ্দীনের আজান দেওয়া শুরু। সবার আগে মসজিদে চলে আসেন। মসজিদ পরিষ্কার করেন। ঝাড়ু দেন। ধোয়ামোছা করেন। পানি তোলেন। মোটর ছাড়েন।
আরো কত কাজ করেন স্বেচ্ছায়। মনের মাধুরী মিশিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান দেন। মানুষকে নামাজের প্রতি ডাকেন। ছোট বাচ্চাদের কানমলা দিয়ে বলেন, ‘তোর বাপরে নামাজে পাঠাবি। তুই সকালে মক্তবে পড়তে আসবি।’ এভাবে তিনি একদিন মসজিদের নির্দিষ্ট মুয়াজ্জিন বনে যান। আজানের বিনিময়ে কোনো টাকা নেন না। আজান দিতে পারেন—এতেই খুশি।
আজানের টানে
হাফিজ উদ্দীনই সবার আগে মসজিদে আসেন। মসজিদ ঝাড়ু দেন, পরিষ্কার করেন, নামাজ শেষে মসজিদের দরজা-জানালা বন্ধ করেন। শীত-বর্ষা সব যেন তার বসন্ত। ৩৭ বছর ধরে এলাকার মানুষের ঘুম ভাঙে তার আজান শুনে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কিংবা আত্মীয়ের বাড়ি তার ভালো লাগে না। মন পড়ে থাকে বাড়িতে। কোথাও গেলে আজানের টানে মনটা বাড়ি ফিরতে ছোটাছুটি করে।
সহজে কোথাও যান না। একান্ত কোথাও গেলেও রাতে থাকেন না। ফজরের আজানের জন্য বাড়ি ছাড়া ভিন্ন কোথাও রাত কাটানো বাদ দিয়েছেন সেই শুরুতে। এ জন্য শুরুতে মেয়েরা রাগ করত। আত্মীয়স্বজন মন খারাপ করত। এখন সবারই সয়ে গেছে। তারা বলেন, ‘এই আজানপাগল মানুষের সঙ্গে আর পারা গেল না।’
হাফিজ উদ্দীন বললেন, ‘আজানের মায়ায় পড়ে গেছি। আজান দিতে না পারলে মনটা কেমন কেমন করে। কোথাও গিয়ে থাকতে পারি না। রাতেও কারো বাড়ি থাকি না। থাকতে ভালো লাগে না। এতে মেয়ে কিংবা আত্মীয়রা মন খারাপ করলে কিছু করার নেই। মনটা ওই মসজিদে, মসজিদের মাইকের সঙ্গে বেঁধে গেছে।’
সবই করেন আল্লাহকে ভালোবেসে
মানুষ তাকে মুয়াজ্জিন বলবে, বাহবা দেবে, টাকা পাবে—এ সবের জন্য তিনি আজান দেন না। তিনি আজান দেন একমাত্র আল্লাহকে ভালোবেসে।
হাফিজ উদ্দীন বললেন, ‘সেই যৌবনে হুজুরের এক বয়ানে শুনেছি, মুয়াজ্জিনদের অনেক ফজিলত। তখন থেকেই আজান দেওয়ার ইচ্ছা করেছি। আজান দিই, আল্লাহকে ভালোবেসে। আল্লাহর প্রিয় হতে। মানুষের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না।’
পরিবার-পরিজন
সাত ভাই-বোনের মধ্যে হাফিজ উদ্দীন সবার বড়। চার সন্তানের পিতা তিনি। এক ছেলে হাফেজ মাওলানা, তাকে নিয়ে হাফিজ উদ্দীনের গর্বের শেষ নেই।
তার ছেলে সোলাইমান বলেন, ‘বাবাকে ছোট থেকে দেখে আসছি বিনা বেতনে মসজিদে আজান দেন। আমার বাবাকে মানুষ মুয়াজ্জিন ডাকে। এতে আমরা খুশি, আমরা গর্বিত। বাবা এভাবে বেঁচে থাকুক আমাদের মাঝে।’
মুয়াজ্জিনের ফজিলত
হাদিসে মুয়াজ্জিনের ব্যাপারে অনেক ফজিলতের কথা রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মুয়াজ্জিনের গর্দান সবচেয়ে উঁচু হবে।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ৬৫৪)
ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ১২ বছর আজান দেবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। তার আজানের কারণে প্রত্যেক দিন ৬০টি এবং প্রত্যেক ইকামতের জন্য ৩০টি সওয়াব লেখা হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৭২৮)
আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ (রহ.) আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান আনসারি মাজিনি (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, আবু সাইদ খুদরি (রা.) তাকে বলেন, আমি দেখছি তুমি বকরি চরানো এবং বন-জঙ্গলকে ভালোবাসো। তাই তুমি যখন বকরি চরাতে থাকো বা বন-জঙ্গলে থাকো এবং নামাজের জন্য আজান দাও, তখন উচ্চ কণ্ঠে আজান দাও। কেননা, জিন, মানুষ বা যেকোনো বস্তুই যতদূর পর্যন্ত মুয়াজ্জিনের আওয়াজ শুনবে, সে কিয়ামতের দিন তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। তিনি বলেন, এ কথা আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে শুনেছি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৮২) সূত্র: কালের কণ্ঠ