মহানবী (সা.) এর মানবতা
ইসলাম ডেস্ক: বিপণ্ন মানুষের মানবতা, অন্ধকারের আলোর দিশা মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম— এভাবে এক কথায় শেষ করা যাবে না তাঁর জীবনী পাঠ। আরও অনেক বিশেষণ তাঁর জন্য। তাঁর জন্য অফুরন্ত দরুদ-সালাম। আসলে তিনি কেমন ছিলেন এ পর্যায়ে আমরা একটু সংক্ষেপে দৃকপাত করতে চাই। প্রথমে আমরা আসুন লক্ষ্য করি কুরআনে কী বলা হচ্ছে। ইরশাদ হচ্ছে—তিনি ‘শুধু আমাদের মতো একজন মানুষ’
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاء رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا
বল, ‘আমি তো তোমাদের মতো একজন মানুষই, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহ্ একমাত্র ইলাহ্। সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে ও তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে। (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ১১০)
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَاسْتَقِيمُوا إِلَيْهِ وَاسْتَغْفِرُوهُ وَوَيْلٌ لِّلْمُشْرِكِينَ
বল, ‘আমি তো তোমাদের মতো একজন মানুষই, আমার প্রতি ওহী হয় যে, তোমাদের ইলাহ্ একমাত্র ইলাহ্। অতএব তোমরা তারই পথ দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর এবং তারই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। দুর্ভোগ অংশীবাদীদের জন্য। (সূরা হা-মীম আস্-সাজ্দাঃ ৪১:৬)
বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থাটি পাঠ করলে দেখা যাবে, তিনি অতিশয় দ্যুতিময় একজন মানুষ-যার প্রতিটি কর্ম সকলের জন্য করণীয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলতেন। অসঙ্কোচ, অনাড়ষ্ট, দ্ব্যর্থবোধক, ও অর্থপূর্ণ কথা। সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতার গুণবৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে ছিল। এ সবই ছিল প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া গুণরাজী। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, প্রিয়নবীকে দু’টি কাজের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হলে সহজ কাজটিই বেছে নিতেন। পাপের সাথে সম্পৃক্ত কাজ থেকে তিনি দূরে থাকতেন। তিনি ক্রোধ ও দুর্বিনীত ব্যবস্থা থেক দূরে ছিলেন। সকলের প্রতি তিনি সহজেই রাজী হয়ে যেতেন। তাঁর দান ও দয়াশীলতা পরিমাপ করা অসম্ভব ছিল। তিনি কল্যাণ ও দানশীলতায় পরিপূর্ণ বাতাসের চেয়ে অগ্রণী ছিলেন।
বীরত্ব ও বাহাদুরীর ক্ষেত্রে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থান ছিল সবার উপরে। তিনি ছিলেন সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বীর। তিনি সুকঠিন সময়েও পশ্চাৎপসারণ না করে সামনে এগিয়ে যেতেন। তাঁর চেয়ে বেশী দৃঢ়তার সাথে অন্য কেউ শত্রুর মোকাবেলা করতে সক্ষম হতো না।
তিনি ছিলেন সর্বাধিক লাজুক প্রকৃতির। তিনি সাধারণত মাটির দিকে দৃষ্টি রাখতেন। কোনো কিছু তাঁর পছন্দ না হলে তাঁর চেহারা দেখেই বোঝা যেত। লজ্জাশীলতা ও সম্মানবোধ এত প্রবল ছিল যে, কারো মুখের ওপর সরাসরি অপ্রিয় কথা বলতেন না। তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশী ন্যায়পরায়ণ পাক-পবিত্র, সত্যবাদী এবং বিশিষ্ট আমানতদার। বন্ধু, শত্রু সকলেই এটা স্বীকার করতেন। তিনি ছিলেন অতি বিনয়ী ও নিরহঙ্কার। বিশ্বজাহানের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূল (সা.) নিজের জুতো, কাপড় নিজেই সেলাই করতেন। নিজ বকরি দোহন করা ইত্যকার নানা সাংসারিক কাজ তিনি নিজ হস্ত মোবারক দিয়েই করতেন।
অঙ্গীকার পালনে তিনি ছিলেন অগ্রণী। তিনি আত্বীয়-স্বজনের প্রতি অতিমাত্রায় খেয়াল রাখতেন। মানুষের সাথে সহৃদয়তা ও আন্তরিকতার সাথে মেলামেশা করতেন। স্বভাবগতভাবেই তিনি কখনো অশালীন কথা বলতেন না। কাউকে কখনো অভিশাপ দিতেন না। উচ্চস্বরে কথা বলতেন না। তাঁর খাবার-দাবার, আচার-আচরণ, কথা-বার্তা সকল কিছু সকল মানুষের প্রতি সমান ছিল। তিনি কাউকে ছোট মনে করতেন না।
সাইয়্যেদুল মুরসালিন প্রিয়নবী (সা.) বেশীরভাগ সময় গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। অপ্রয়োজনে কথা বলতেন না। কথার শুরু ও শেষে সুস্পষ্ট উচ্চারণ করতেন। তিনি ছিলেন নরম মেজাজের অধিকারী। তিনি কখনো সমালোচনা করতেন না। সত্য ও ন্যায়ের পরিপন্থী কোনো কিছু দেখলে তিনি বিরক্ত হতেন। তাঁর মন ছিল বড় উদার। তিনি কাউকে ইশারা করতে চাইলে হাতের পুরো তালু ব্যবহার করতেন। বিস্ময়ের সময় হাত উল্টাতেন। ক্রুদ্ধ হলে মুখ ফিরিয়ে নিতেন এবং খুশী হলে দৃষ্টি নিচু করতেন। অধিকাংশ সময়ে মৃদু হাসতেন। হাসির সময়ে তাঁর দাঁতের কিয়দংশ ঝকমক করত।
তিনি সম্মানিত লোককেই নেতা নিযুক্ত করতেন। মানুষের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকতেন। সাহাবাদের খবরা-খবর নিতেন। সব বিষয়েই মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতেন। কোনো বিষয়ে অমনোযোগী থাকা তিনি পছ
ন্দ করতেন না। তাঁর কাছে তাঁদের মর্যাদাই ছিল অধিক— যারা ছিলেন অন্যের দুঃখে কাতর, স্বভাবতই গম্ভীর এবং অন্যের সাহায্যকারী। তিনি উঠতে বসতে সর্বদাই আল্লাহকে স্মরণ করতেন। তাঁর বসার জন্য আলাদা কোনো জায়গা ছিল না। যেখানে খালি জায়গা পেতেন সেখানেই বসতেন। তিনি ছিলেন সবার কাছে পিতৃতুল্য। তিনি তাদেরকেই অধিক সম্মান দিতেন যারা বেশীমাত্রায় তাকওয়ার অধিকারী। তাঁর মজলিস বা সমাবশ ছিল জ্ঞান, ধৈর্য, লজ্জাশীলতা ও আমানতদারীর মজলিস। তিনি বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করতে আদেশ দিতেন। অপরিচিত লোককে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করা হতো না।
তিনি তিনটি বিষয় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতেন। ১) অহঙ্কার ২) কোনো জিনিসের বাহুল্য এবং ৩) অর্থহীন কথা। আর তিনটি বিষয় থেকে লোকদের নিরাপদ রাখতেন। এগুলো হচ্ছে— ১) পরের নিন্দা ২) কাউকে লজ্জা দেওয়া এবং ৩) অন্যের দোষ প্রকাশ করা।
তিনি এমন কথাই শুধু মুখে আনতেন, যে কথায় সওয়াব লাভের আশা থাকত। তিনি যখন কথা বলতেন তখন সাহাবীগণ এমনভাবে মাথা নিচু করে বসতেন যে, মনে হতো তাদের মাথায় চড়ুই পাখি বসে আছে। তিনি হাসলে সাহাবীগণ হাসতেন, তিনি অবাক হলে তারাও অবাক হতেন, তিনি নীরব হলে সবাই নীরব হয়ে যেতেন। এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন তাঁর মজলিশের সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাশীল। পোশাক পরিধানে তিনি ছিলেন অতীব শালীন।
মোটকথা, মহানবী (সা.) তুলনাহীন গুণবৈশিষ্ট্যের অধিকারী একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ ছিলেন। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন। আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় নবীর সম্মানে বলেছেন, ইন্নাকা লা আলা খুলুকিন আযীম’, অর্থাৎ নিঃসন্দেহে আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী’। এটি এমন তুলনাবিহীন গুণ যার কারণে মানুষ তাঁর প্রতি ছুটে আসত। তাঁর প্রতি মানুষের মনে ভালোবাসা ছিল বদ্ধমূল। মানবীয় গুণাবলীর সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর স্বজাতির রুক্ষতা পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল।
তিনি সব ধর্মের প্রতি উদারতায়, বিধর্মীদের সাথে ব্যবহারে, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মহামানবতায়, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে, নারীজাতির উন্নয়নে, মাতৃভক্তিতে, সাম্য ও মৈত্রী স্থাপনে, সুদক্ষ কূটনীতিকরূপে, ক্রীতদাসদের মুক্তিদানে, জ্ঞান-সাধনায়, আল্লাহর প্রতি নির্ভরতায়, ক্ষমায়, ন্যায়বিচারে, বদান্যতায়, জীবে দয়ায়, শ্রমের মর্যাদা দানে, স্বামীরূপে, গৃহীরূপে, পিতারূপে, স্বাবলম্বনে, চরিত্র-মাধুর্যে, বীরবেশে, রাষ্ট্রনায়করূপে সেনাপতিরূপে, আদর্শ প্রতিষ্ঠায়, বিবাহ-প্রথার উন্নয়নে, বহুবিবাহের ব্যবস্থায়, যুগ সমস্যার সমাধানে, বৈজ্ঞানিকরূপে, অতিথি সেবায়, আর্ত, পীড়িত ও দুর্গতদের সেবা ও সাহায্যদানে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে ও অন্যান্য কার্যে, নাগরিক জীবনের কর্তব্য পালনে, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সফল মানুষরূপে তথা মানবীয় সকল গুণরাশির সর্বোচ্চ শিখরে তাঁর স্থান ছিল। মোটকথা সকল গুণবাচক বিশেষণের তিনিই ছিলেন শেষ কথা।
আসলে মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। পূর্ণতার শ্রেষ্ঠতম আদর্শ এ মহান মানুষের পরিচয় এই যে, তিনি মানবতার সর্বোচ্চ চূড়ায় সমাসীন ছিলেন। তিনি মহান রাব্বুল আলামীনের পবিত্র আলোক আভায় এমনভাবে আলোকিত ছিলেন যে, কোরআন করিমকেই তাঁর চরিত্রের পরিচয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল পবিত্র কুরআনেরই বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন।-দ্য রিপোর্ট
২৫ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ/ রাসেল/মাহমুদ