ইসলাম ডেস্ক: মাকে সম্মান ও শ্রদ্ধার দাবি তো প্রতিটি মুহুর্তের জন্য, তবে কী কারণ ছিল এই একটি দিন নির্ধারণের? যে সমাজে মা বাবাকে ফেলে আসা হয় বৃদ্ধাশ্রমে, সেখানে একটি দিন মায়ের জন্য মায়াকান্না কেঁদে তাকে ভুলে থাকো পুরো বছর!
অকৃত্রিম মায়ের প্রতি এমন মেকি সম্মান দেখিয়ে আমরা কি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছি না তাদের বুকের দহন?বর্তমানে আমাদের সমাজে গড়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রম, আমাদের মানসিক ও নৈতিক অধঃপতনের নির্মম এক উদাহরণ।
ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য এবং অপার উদারতার অন্যতম নির্দশন হচ্ছে, ইসলামে মা বাবা কাফের মুশরিক হলেও তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারের জন্য সন্তানদের প্রতি জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
মায়ের প্রতি অবাধ্যতা ও খারাপ ব্যবহারের প্রতিফল এতই ভয়ানক যে, আল্লাহ পাক দুনিয়াতেই এর শাস্তির সূচনা করেন। পরকালে তো রয়েছেই।
আমাদের চারপাশে আমরা অনেক ‘কুসন্তান’ দেখি, যারা তাদের মায়ের সাথে নিত্যদিন অবহেলা আর বেয়াদবি করছে, চড়া গলার বকুনী আর শরীরের ঝাঁকুনিতে উড়িয়ে দেয় মায়ের স্নেহমাখা কণ্ঠকে, তবু মায়েরা তাদের ভুলেন না, ভুলতে পারেন না। কারণ সন্তান হয়তো নরাধম, কিন্তু মা তো আর নির্মম হতে পারেন না। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অনবরত আমরা পেয়ে যাই মায়ের মমতাময়ী মন আর তার সযত্ন প্রতিপালন- আল্লাহর কি অপার নিদর্শন।
মায়ের জন্য ভালোবাসা, এই একটি মাত্র বিষয়, আল্লাহ যেখানে কোনো ছাড় দেননি। মায়ের সাথে ব্যবহারের বিষয়টিকে তিনি মিলিয়ে রেখেছেন নিজের সাথে। বারবার বলেছেন, তোমরা শিরক করো না আল্লাহর সাথে, আর মা বাবার অবাধ্য হয়োনা..।
শুধু কি তাই, বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন ভঙ্গিতে তিনি আমাদের এ বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘আর আমি মানুষকে ওসিয়ত করছি, তারা যেন তাদের মা বাবার সাথে ভালো ব্যবহার করে। তার মা তাকে কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে, তারপর কত যন্ত্রণায় তাকে প্রসব করেছে..’(সূরা আহকাফ-১৫)
একজন মা তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন, তারপর তাকে জন্মদান করেন, তারপর তাকে কোলে করে দুধ পান করান, তার মুখে খাবার তুলে দেন যতদিন শিশুটি নিজে খেতে না পারে, রাতভর জেগে থাকেন, চোখের আড়াল হলেই উৎকণ্ঠায় থাকেন, সামান্য অসুখ বিসুখে অনবরত চোখের পানি ফেলেন, নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও সন্তানের মঙ্গলের জন্য স্রষ্টা কাছে হাত পাতেন যে মা, আজকের এ যান্ত্রিকতার যুগে খুব সহজেই কি তাকে ভুলে যাই আমরা? মায়ের চোখের পানিকে একটুও ভয় হয়না?
অথচ ইসলাম! মায়ের কোনো ব্যবহার কিংবা কথায় সামান্য আহ বা উফ শব্দটিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আল্লাহ পাক নিজের ভাষায় এ শব্দ উল্লেখ করে সতর্ক করেছেন, সাবধান! মা বাবার সামনে কখনো যেন উফ শব্দটিও মুখ থেকে বের না হয়।
তাদের তোমরা ধমক দিয়ো না, তাদের সাথে নরম হয়ে কথা বলো। দয়া ও মায়ার ব্যবহার করো নিজের মা বাবার সাথে। যতদিন তারা বেঁচে থাকেন, তাদের সেবায় নিমগ্ন থেকো আর তাদের মৃত্যুর পর তাদের জন্য দুআ করো। (ভাব অনুবাদ, সূরা ইসরা-২৩,২৪)
জীবনের প্রতিটি পদে পদে আল্লাহ পাক এভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে মায়ের সাথে আচার আচরণ করতে হবে। শুধু কুরআনের ভাষায় বারবার তাগিদ দিয়ে নয়, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (সা.) এর মাধ্যমেও এর বাস্তব প্রতিফলন দেখিয়ে সজাগ করেছে ইসলাম।
রাসুল (সা.) কে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন, আল্লাহর সাথে শিরক করা আর মা বাবার অবাধ্য হওয়া। (বুখারী)
আরেক হাদীসে তিনি বলেছেন, সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহগুলোর অন্যতম হল, নিজের মা বাবাকে গালি দেওয়া। সাহাবারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! মানুষ আবার কিভাবে নিজের মা বাবাকে গালি দিতে পারে? তিনি বললেন, কেউ যদি অন্যের মা বাবাকে গালি দেয়, তবে ওই লোকটি নিশ্চয়ই প্রতিউত্তরে এ লোকটির মা বাবাকেও গালি দেবে। (বুখারী)
রাসুল (সা.) বলেছেন, মা বাবার প্রতি ভালো ব্যবহারের শেষ সীমানা হল, তাদের যারা বন্ধুবান্ধব ছিলেন, তাদেরও সম্মান করা, ভালোবাসা ও দয়া করা। (মুসলিম)
অন্যত্র আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়, বাবার সম্মানের চেয়ে মায়ের সম্মান ও শ্রদ্ধা তিনগুণ বেশি।
মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে রাসুলের কান্না দেখে নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন সাহাবায়ে কেরাম, রাসুলের কান্নায় তারাও কেঁদেছিলেন সেদিন। আর কোনোদিন কোথাও তাকে এভাবে কেউ কাঁদতে দেখেনি, মায়ের জন্য আপ্লুত হয়ে তিনি যেভাবে কেঁদেছিলেন। (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)
মায়ের প্রতি রাসুলের ভালোবাসা ও সদাচারের জন্য রাসুল (সা.) এর তাগিদ দেখে সাহাবায়ে কেরামও নিজেদের মায়ের প্রতি ছিলেন পরম বিনয়ী ও সদাচারী।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) যখনই কোথাও যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হতেন, ডাক দিয়ে বলতেন, ‘মা আমার! তোমরা জন্য সালাম! আল্লাহ পাক তোমাকে রহমত দিয়ে ঘিরে রাখুন যেভাবে তুমি আমাকে ছোটবেলায় লালন পালন করেছিলে।’ তার মা তখন সাড়া দিয়ে বলতেন, ‘ছেলে আমার! আল্লাহ তোমাকেও রহমত দান করুন যেভাবে তুমি আমাকে এই বুড়ো বয়সে সেবাযত্ন করছো।’
আরেক বিখ্যাত সাহাবী ইবনে মাসউদ (রা.) এর মা এক রাতে ঘুম ভেঙ্গে পানি চাইলেন। ইবনে মাসউদ দৌঁড়ে পানি আনতে গেলেন। ততক্ষনে মা আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। মা হয়তো বিরক্ত হবেন, সেজন্য তিনি আর তার ঘুম ভাঙ্গালেন না, আবার যে কোনো সময় ঘুম ভেঙ্গে হয়তো পানি চাইবেন, তাই সারারাত পানি নিয়ে মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে রাত কাটিয়ে দিলেন।
এমন অজস্র ঘটনা ইতিহাসের পাতায় পাতায় ভরা, তবু আমরা উদাসীন এ পরম নেয়ামতের মূল্যায়ন থেকে।
ইবনে আওন আল মুযানী ছিলেন প্রসিদ্ধ আলেম ও বুযুর্গ। তার মা তাকে ডাকলেন, তিনিও সাড়া দিলেন ‘জি আসছি’ বলে, কিন্তু অনিচ্ছায় তার গলার আওয়াজ কেমন যেন চড়া হয়ে গেল। এ সামান্য আওয়াজ উঁচু হয়ে যাওয়ায় তিনি অনুতপ্ত হলেন আল্লাহর কাছে, দু’টি গোলাম তিনি মুক্ত করে দিলেন এর কাফফারা হিসেবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, তিনটি বিষয় এমন রয়েছে, যেগুলো একটি না হলে অন্যটিও আল্লাহ কবুল করেন না। এর মধ্যে তৃতীয়টি হল, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা এবং মা বাবার প্রতি সদাচারণ করা। সুতরাং যে আল্লাহকে মানে কিন্তু তার মা বাবার সাথে সদাচারণ করে না, তার কোনো ইবাদতই কবুল হয় না।
এর চেয়েও ভয়ানক বিষয় হলো, আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, জিবরাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আ.) ওই ব্যক্তির জন্য বদ দুআ করেছেন, যে তার বৃদ্ধ মা বাবাকে পেয়েও তাদের সেবা যত্ন করার মাধ্যমে নিজেদের জান্নাত অর্জন করে নিতে পারলো না। আর রাসুল (সা.) এ দুআয় আমিন বলেছেন। (বায়হাকী)
ভাবা যায়! কত বড় সাংঘাতিক অভিশাপ তেড়ে আসে শুধু মা বাবার সেবাকে তুচ্ছ করার কারণে? মায়ের হাসিমাখা মুখ আমাদের জন্য মহান আল্লাহর দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। তাই তোমাকে সালাম, হে মা আমার!