ফেরেশতাসুলভ গুণাবলি ও মহান রাব্বুল আলামিনের বিশেষ রহমত লাভের যোগ্যতা অর্জনের মাস রমজানুল মোবারকের আজ ১৯ তারিখ। আর মাত্র এক দিন পর থেকে রমজানের শেষ দশক শুরু হবে। ২০ রমজানের পর থেকে এ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত একটি বিশেষ ইবাদত রয়েছে। দিনের ২৪ ঘণ্টাই মসজিদে অবস্থান এবং ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানোর এই ইবাদতের নাম ইতিকাফ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি বছর রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করতেন। তার ইন্তেকালের পরে উম্মাহাতুল মু’মিনিন এ আমল অব্যাহত রাখেন বলে তিরমিজি শরিফে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন।
ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ইতিকাফকারী সব ধরনের গোনাহর কাজ থেকে বিরত থাকে এবং তার নামে লেখা হয় সব নেক কাজ সম্পাদনকারীর মতো সওয়াব। অর্থাৎ ইতিকাফ না করলে তার পক্ষে যেসব নেক কাজের সুযোগ ছিল, এখন সেগুলো করতে না পারলেও তাকে সওয়াব দেয়া হবে। তিন ধরনের ইতিকাফ রয়েছে- ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফল। মান্নতের কারণে ইতিকাফ ওয়াজিব হয়। সেটির পরিমাণ কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা হতে হয় এবং ইতিকাফের মান্নতের সাথে রোজা রাখাও ওয়াজিব হয়ে যায়। তাই যে কয়দিন ইতিকাফের মান্নত করবে, সে কয়দিন রোজার সাথেই ইতিকাফ করতে হবে। সুন্নাত ইতেকাফ হয় রমজানের শেষ দশকে। রমজানের ২০ তারিখের সূর্যাস্তের আগ থেকে তা শুরু করতে হয়। আর তা শেষ হয় রমজান শেষ হলে। অর্থাৎ ২৯ তারিখে চাঁদ দেখা গেলে বা ৩০ তারিখ পূর্ণ হলে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু প্রতি বছর রমজানের শেষ দশক অবশ্যই ইতিকাফে অতিবাহিত করতেন এবং এক বছর তা ভঙ্গ করার কারণে পরের বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন, এ জন্য প্রতিটি মসজিদে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়াহ। অর্থাৎ কমপক্ষ একজন মুসল্লির ইতিকাফ দ্বারাই মহল্লার সবাই দায়মুক্ত হবে। পক্ষান্তরে কেউ ইতিকাফ না করলে ওই মসজিদের আওতাধীন সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে।
নফল ইতিকাফের সময়সীমা নির্ধারিত নেই। আধা দিন এমনকি কয়েক ঘণ্টার জন্যও নফল ইতিকাফ হতে পারে। সে কারণে ওয়াজিব ও সুন্নাত ইতিকাফের ব্যাপারে রোজা শর্ত হলেও নফল ইতিকাফের ব্যাপারে রোজা শর্ত নয়।
ইসলামে বৈরাগ্য নেই, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা স্পষ্ট জানিয়ে গেছেন। আসলে কোনো নবীর শরিয়তেই বৈরাগ্যের বিধান ছিল না। তবে হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের অবর্তমানে তার কিছু নিষ্ঠাবান অনুসারী সমকালীন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশে নিজেদের ঈমান ও ইবাদত হিফাজত করতে পারবেন না আশঙ্কা করে বৈরাগ্যের পথ বেছে নিয়েছিলেন; কিন্তু যেহেতু তা ছিল মানবজীবনের জন্য অস্বাভাবিক, তাই তাদের পক্ষে এ রীতি রক্ষা করা সহজ ছিল না। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজিদের সুরা হাদিদে ইরশাদ হয়েছে- আর তারা আবিষ্কার করেছিল বৈরাগ্য। আমরা তাদের জন্য তা আবশ্যক করিনি; কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারেনি।
আখেরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, পারিবারিক ও সামষ্টিক জীবনের কাঠামো বজায় রেখেই মানুষকে আখেরাতের কাজ করতে হবে; কিন্তু এই স্থায়ী বৈরাগ্য অনুমোদিত না হলেও সাময়িকভাবে নিজের পরিবার ও বৈষয়িক কাজকর্ম থেকে বিমুখ থেকে পুরো সময় সালাত, জিকির, কুরআন তিলাওয়াত প্রভৃতিতে কাটানোর ব্যবস্থা এই শরিয়তে আছে। ইতিকাফ সেই সাময়িক বৈরাগ্য। রমজানের শেষ দশ দিন পার্থিব সব কাজকর্ম থেকে মুক্ত থেকে মসজিদে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করা এই উম্মতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। এটা দুনিয়ার প্রতি আসক্তি কমাতে ও আখেরাতের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধিতে অত্যন্ত সহায়ক। এ জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দিয়েছেন। শুধু মসজিদে অবস্থান এবং ফরজ নামাজগুলো যা প্রতিদিনের স্বাভাবিক আমল তা করলেও ইতিকাফের হুকুম পালন হয়ে যায়; কিন্তু উত্তম এই যে, ন্যূনতম সময় বিশ্রাম ও নিদ্রায় কাটিয়ে বাকি পুরো সময় নফল নামাজ, কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত ও জিকির -তাসবিহ পাঠে কাটানোর চেষ্টা করতে হবে।
সাময়িক বৈরাগ্যের অনুশীলন ইতিকাফের প্রথম তাৎপর্য। দ্বিতীয়ত, রমজানের প্রথম দিন থেকে রোজা পালন করতে করতে যখন ২০টি দিন হয়ে যায়, তখন রোজা রাখা অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়। আর কোনো আমল যখন অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার প্রভাব কমতে থাকে, সে দিকে লক্ষ থাকে কম। তাই রমজানের সিয়াম সাধনা যেন অভ্যাসগত কাজের অন্তর্ভুক্ত না হয়, বরং বিশেষ গুরুত্ব ও মনোযোগের বিষয় থাকে, সে জন্য সিয়াম সাধনার মাসের শেষ দিনগুলো একান্তভাবে সিয়াম ও সালাতের জন্য বরাদ্দ রাখার একটি নিয়ম এই ইতিকাফ।
ইতিকাফের তাৎপর্য আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। তা এই যে, পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে নিজেকে বিরত রাখার ধারাবাহিকতা বান্দার মধ্যে সৃষ্টি করে আল্লাহপ্রেমের বিশেষ প্রেরণা। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মোতাবেক নিজের দৈহিক চাহিদা ও আচরণ সংযত রাখার ফলে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে বান্দা অনেক উন্নতি লাভ করে। নশ্বর পৃথিবীর আকর্ষণ দুর্বল হতে থাকে, পরজগতের চিন্তা প্রবল হতে থাকে, আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য তার মধ্যে ব্যাকুলতা বাড়তে থাকে। তারই অভিব্যক্তি ঘটানো হয় সংসার ও বৈষয়িক জীবন থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর ঘরে নিরবচ্ছিন্ন অবস্থানের মধ্য দিয়ে। আল্লাহ তায়ালার প্রতি বান্দার অনুরাগ ও প্রেমের পরাকাষ্ঠা ঘটে বায়তুল্লাহর হজের মাধ্যমে। আর রমজান মাসের পরেই শুরু হয় হজের মওসুম। ইতিকাফের মাধ্যমে বায়তুল্লাহর হজের প্রস্তুতি শুরু করে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা। অতএব ইতিকাফ আল্লাহপ্রেম ও আখেরাতমুখিতার উজ্জ্বল নমুনা।