ইসলাম ডেস্ক: আমি যখন কোরআন নিয়ে পড়াশুনা শুরু করি তখন কোরানের যে জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে বেশি ইমপ্রেসড করে সেটি হলো 'মৌমাছি' সংক্রান্ত আয়াতগুলি। যখন কোন নাস্তিক আমার সাথে কোরআন নিয়ে তর্কে বসে, আমি তাকে (যদি সে প্রাণী বিজ্ঞানের ছাত্র হয় বা প্রাণী বিজ্ঞান সম্পর্কে জেনে থাকে) মৌমাছির জীবন চক্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। বেশকিছু নাস্তিককে আমি মৌমাছির জীবন চক্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি, এবং তাদের অনেকেই এই ব্যাপারে খুব ভাল জ্ঞান রাখে।বিলিভ ইট অর নট, নাস্তিকরা প্রচুর পড়াশোনা করে।কিন্তু তারা মিসগাইডেড বলে সত্যটা জানতে পারেনা,বা জানলেও মেনে নেয়না।
সে যাইহোক, যখনই তাদেরকে আমি কোরআনে বর্নিত মৌমাছির জীবন চক্র আর মডার্ণ সাইন্সের আবিষ্কৃত মৌমাছির জীবন চক্রের মধ্যে একটি মিলবিন্যাস দেখাই, তাদের কেউই আমাকে কোন উত্তর দিতে পারেনি।চুপসে গিয়েছিলো।
আজকে জিনিসটি নিয়ে আলোচনা করা যাক।প্রথমেই বলে রাখি, কোরআন বিজ্ঞানের মাপকাঠি নয়,আর বিজ্ঞানও কোরআনের মাপকাঠি নয়।কোরআন বিজ্ঞানের কোন কিতাবও নয়।এখানে ঠিক ততটুকু বিজ্ঞান নিয়েই আল্লাহ আলোচনা করেছেন, যতটুকু কোরআন নাযিলের সময় প্রাসঙ্গিক ছিল।
যেমন, আকাশ নিয়ে যখন বলা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই এর গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে বলতে হয়েছে। মৌমাছি নিয়ে যখন বলছিলো, তখন স্বাভাবিকভাবে তাদের জীবনচক্র নিয়ে বলতে হয়েছে।আর সেটা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে মিলে যাচ্ছে।কোরআন-বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করতে হলে, এই কনসেপ্টটি মাথায় রাখাটা জরুরি। এবার আসুন মৌমাছির জীবনচক্র সম্পর্কে জেনে নিই।
বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানিদের মৌমাছির জীবন চক্র নিয়ে সুস্পষ্ট কোন ধারনা ছিলনা। তারা গতানুগতিক একটি ধারনার উপর মনে করতো, মৌমাছি দুই রকমের। একটি হলো- পুরুষ মৌমাছি। এদের কাজ স্ত্রী মৌমাছিদের সন্তান উৎপাদন কার্যে সহায়তা করা,গৃহ (মৌচাক) নির্মাণ,ফুল থেকে মধু সংগ্রহ,গৃহ পাহারা দেওয়া ইত্যাদি।
আরেকটি হলো- স্ত্রী মৌমাছি(Queen Bee)।এদের কাজ হলো শুধু সন্তান উৎপাদন। এটি ছিল বিজ্ঞানিদের প্রথমদিকের ধারনা। শেক্সপিয়ারের অনেকগুলো বিখ্যাত নাটকের একটি হলো- 'Henry The Fourth'। ধারনা করা হয়,শেক্সপিয়ার এটি লিখেছিলেন ১৫৯৭ সালের দিকে,এবং এটি প্রিন্টেড হয় ১৬০৫ সালের দিকে।
সেই নাটকে এক পর্যায়ে বলা হয়েছে, পুরুষ মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে এবং তাদের একজন রাজা থাকে।দিনশেষে সব সৈনিক মৌমাছিদের এই 'রাজা' মৌমাছির কাছে এসে কৈফিয়ত দিতে হত কি কি কাজ তারা পুরোদিনে করেছে।
এটি ছিল শেক্সপিয়ারের সময়কার লোকজনের মৌমাছি নিয়ে ধারনা। কিন্তু বিজ্ঞান তখনও আবিষ্কার করতে পারেনি আসল কাহিনীটা। ১৯৭৩ সালে অষ্ট্রিয়ান বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch 'Physiology or Medicine' বিষয়ে সফল গবেষণার জন্য চিকিৎবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।তার গবেষণার বিষয় ছিল 'মৌমাছির জীবনচক্র'।
তিনি এই বিষয়ে একটি বই লিখেছেন যার নাম 'The dancing bees'। তিনি বৈজ্ঞানিক ভাবে(ফটোগ্রাফি এবং অন্যান্য পদ্ধতি অবলম্বন করে) প্রমান করে দেখিয়েছেন যে, মৌমাছি তিন ধরনের। প্রথমটি হচ্ছে- স্ত্রী মৌমাছি।এদের কাজ শুধু সন্তান উৎপাদন।আর কোন কাজেই এরা অংশগ্রহণ করেনা।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে- পুরুষ মৌমাছি।এদের কাজ হচ্ছে শুধু স্ত্রী মৌমাছিদের (Queen bee) সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রজনন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা।এর বাইরে এরা আর কোন কাজ করেনা। তৃতীয়টি হচ্ছে- এরাও স্ত্রী মৌমাছি কিন্তু বন্ধ্যা।মানে,এরা কখনই সন্তান উৎপাদন করতে পারেনা।প্রাকৃতিক ভাবেই এরা বন্ধ্যা হয়ে থাকে।এদের অন্য নামে বলা হয়- 'কর্মী মৌমাছি'। মৌচাক নির্মাণ,মধু সংগ্রহ সহ তাদের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করে এই কর্মী স্ত্রী মৌমাছিরাই।
পুরুষ মৌমাছি এবং স্ত্রী (Queen bee) মৌমাছি সন্তান উৎপাদন ছাড়া মৌচাক নির্মাণ,মধু সংগ্রহ সহ অন্যকোন কাজেই অংশগ্রহণ করেনা।এসব করে কর্মী মৌমাছি বা দ্বিতীয় ক্যাটাগরির স্ত্রী মৌমাছি। (এদের Queen bee বলা হয়না, Worker Bee বলা হয়)।
তিনি আরো প্রমান করে দেখিয়েছেন যে,যখনই একটি কর্মী মৌমাছি নতুন কোন ফুলের বাগান বা উদ্যানের সন্ধান পায়,তখন সাথে সাথে গিয়ে অন্য কর্মী মৌমাছিদের নতুন এই ফুলের বাগান/উদ্যানের সঠিক দিক নির্দেশনা জানিয়ে দেয়। Karl Von-Frisch এটার নাম দিয়েছেন - 'Waggle Dance'।
শেক্সপিয়ায়ের সময়কার পুরো বিশ্বাস পাল্টে দিয়েছে বিজ্ঞানি Karl Von Frisch এর এই আবিষ্কার। এবার চলুন কোরআন কি বলে দেখা যাক। কোরআনে মৌমাছির নামানুসারে একটি পুরো সূরা আছে।সেটি হলো- সূরা আন-নাহল।আরবিতে 'নাহল' মানে মৌমাছি। এই সূরার ৬৮ এবং ৬৯ নং আয়াতে সরাসরি মৌমাছি নিয়ে কথা বলা হয়েছে। প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটি ব্যাপারে বলে নিই।
সেটি হচ্ছে,- বাংলা/ইংরেজিতে ক্রিয়ার (Verb) কোন লিঙ্গান্তর হয়না।মানে, ক্রিয়ার পুংলিঙ্গ/স্ত্রী লিঙ্গ হয়না। আমরা ইংরেজিতে পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রী-লিঙ্গের জন্য একই verb ব্যবহার করি। যেমন, He does the work.. (পুং লিঙ্গের জন্য does) আবার, She does the work.. (স্ত্রী লিঙ্গের জন্যও does)।
কিন্তু এ্যারাবিকে এরকম নয়।এ্যারাবিকে পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রী লিঙ্গের জন্য আলাদা আলাদা verb ব্যবহৃত হয়।যেহেতু, আল কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে,তাই আমাদেরকে আরবি ব্যাকরণ দিয়েই কোরআন বুঝতে হবে। এবার সূরা আন নাহলের ৬৮ আয়াতে চলে যাওয়া যাক।
আয়াতটি হলো- 'ওয়া আওহা রাব্বুকা ইলান নাহলি আনিত্তাখিযি মিনাল জিবালি বুইঊতাও ওয়া মিনাশ শাজ্বারি ওয়া মিম্মা ইয়ারিশুন।' বাংলা অর্থ- 'আপনার রব মৌমাছিকে আদেশ দিয়েছেন যে, মৌচাক বানিয়ে নাও পাহাড়ে,বৃক্ষে এবং মানুষ যে গৃহ নির্মান করে, তাতে।'
আপনি যদি আরবি ভাষা জানেন বা আরবি ব্যাকরণ বুঝেন, তাহলে অবশ্যই আপনার জানার কথা 'পুরুষ মৌমাছি'র জন্য আরবিতে ব্যবহৃত verb হলো- 'ইত্তাখিজ', আর 'স্ত্রী মৌমাছি'র জন্য ব্যবহৃত verb হলো- 'ইত্তাখিজি'।আলাদা আলাদা শব্দ।
উপরের আয়াতে দেখুন, আল্লাহ সুবহান। ওয়া'তালা উক্ত আয়াতে 'ইত্তাখিজ' ব্যবহার না করে 'ইত্তাখিজি' শব্দ ব্যবহার করেছেন।তাহলে নিশ্চিতরূপে বোঝা গেলো- উক্ত আয়াতে মৌমাছির প্রতি যে নির্দেশ দেওয়া হলো, তা অবশ্যই অবশ্যই স্ত্রী মৌমাছির জন্য।
যদি পুরুষ মৌমাছিকে ইনডিকেইট করা হতো,তাহলে উক্ত আয়াতে কখনোই 'ইত্তাখিজি' ব্যবহার হতোনা, 'ইত্তাখিজ' শব্দ ব্যবহার করতে হতো।যদি 'ইত্তাখিজ' শব্দ ব্যবহার হতো,তাহলে সেটা আরবি ব্যাকরণ অনুসারে ভুল তো হতোই, মডার্ন সাইন্স অনুসারেই সেটা ভুল প্রমান হতো।
কারন বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch প্রমান করে দেখিয়েছেন যে, মৌচাক নির্মাণ, মধু সংগ্রহ ইত্যাদিতে পুরুষ মৌমাছি নয়, স্ত্রী মৌমাছিই অংশ নেয়। চিন্তা করুন, বিজ্ঞান যেটা জানতে পারলো ১৯৭৩ সালে, কোরআন সেটা কতো আগেই সু-স্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছে। সুবাহান-আল্লাহ।।
Karl Von Frisch প্রমান করেছেন, একটি কর্মী মৌমাছি যখন কোন নতুন ফুলের বাগান/উদ্যানের সন্ধান পায়, সাথে সাথে অন্য কর্মী মৌমাছিদের সেই উদ্যান সম্পর্কে অবহিত করে।এক্সাক্টলি যে পথে গিয়ে মৌমাছিটি এই উদ্যানের সন্ধান পায়,অন্যদেরও ঠিক সে পথের সন্ধান দেয়।পথের এই সন্ধান দানে মৌমাছিটি কোনরকম হেরফের করেনা।সে যে পথে গিয়ে তা দেখেছে,ঠিক তাই-ই অন্যদের জানায়।অন্যপথ দিয়ে যেতে বলেনা। Karl Von Frisch এর ভাষায় এটি হলো- ' 'Waggle Dance'।
সুরা নাহলের ৬৯ নং আয়াত দেখুন- ' অত:পর, চোষন করে নাও প্রত্যেক ফুল থেকে,এবং চল স্বীয় রবের সহজ-সরল পথে'। লক্ষ্য করুন, এখানে আল্লাহ বলছেন, 'চলো স্বীয় র'বের সহজ - সরল পথে'। আচ্ছা, এটি কি মানুষকে বলা 'সহজ-সরল' পথ বা 'সিরাতুল মুস্তাকিম'? না। কেন?
কারন, মানুষের পরকালে জবাবদিহির দায় আছে,মৌমাছির তা নেই। তাহলে তাদের কোন সহজ-সরল পথে চলার কথা বলা হচ্ছে? অবশ্যই, এটি Karl Von Frisch এর সেই মৌমাছিদের 'Waggle Dance'। এক্সাক্ট যে পথ,যা তারা জানে।যা তার জন্য সহজ এবং অন্যান্যদের জন্যও সহজ।
সুবাহান-আল্লাহ!! ১৯৭৩ সালে যা আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানি Karl Von Frisch চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন, আল্লাহ সুবাহান ওয়া'তালা তা কোরআনে চৌদ্দশত বৎসর আগেই জানিয়ে রেখেছেন। (আমার ফোনে এ্যারাবিক ফন্ট নেই বলে আয়াতটি বাংলায় লিখতে হলো)
লেখেছেন- আরিফ আজাদ