বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০১৯, ০২:১৭:৪৪

‘রাসুলুল্লাহ (সা.) হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে কান্না শুরু করলেন, কান্নায় দুই নয়ন ভেসে গেল'

‘রাসুলুল্লাহ (সা.) হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে কান্না শুরু করলেন, কান্নায় দুই নয়ন ভেসে গেল'

মো. আবদুল মজিদ মোল্লা: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। তাই হজে মহানবী (সা.)-এর আনুগত্য ও অনুসরণ অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রাসুল তোমাদের যা কিছু দিয়েছেন তা ধরো এবং যা কিছু থেকে বারণ করেছেন তা থেকে বিরত হও।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৭)

অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘রাসুলুল্লাহর  জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ, যারা আল্লাহ ও পরকালে আশান্বিত ও আল্লাহকে স্মরণ করে প্রচুর।’   (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২১)

সুতরাং কবুল হজের জন্য মহানবী (সা.)-এর আনুগত্য করা আবশ্যক। মূলত হজ একটি বিশেষ ইবাদত। এটি কোনো আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়। আল্লাহপ্রেম, তাঁর প্রতি নিবেদন, কষ্টসহিষ্ণুতা, অসীম ধৈর্য, তাওহিদের নিদর্শন দেখে ঈমান মজবুত করা ইত্যাদি হজের মূল বক্তব্য, রাসুলুল্লাহ (সা.) যা নিজ আমলের মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে শিখিয়েছিলেন। আর তাঁরা তা পৌঁছে দিয়েছিলেন পরবর্তী উম্মতের জন্য। নিম্নে হজে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কয়েকটি প্রিয় আমল তুলে ধরা হলো—

আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা
আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ও আত্মার সংযোগ মুমিন বান্দার অমূল্য সম্পদ। এটি ইবাদতকারীর কাঙ্ক্ষিত মূলধন। আর হজ আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করার অন্যতম মাধ্যম। এর মাধ্যমে বান্দা সমর্পণ, আনুগত্য ও তাকওয়া চর্চার সুযোগ পায়। আল্লাহর মহত্ত্ব ও মাহাত্ম্যের নিদর্শনাবলি দেখে ঈমান ও বিশ্বাস দৃঢ় হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন স্বীয় প্রতিপালকের দাসত্ব চর্চায় সর্বোচ্চ শিখরে। হজে তিনি তা আরো দৃঢ় করতে সচেষ্ট হন।

একত্ববাদের যত্ন ও চর্চা
হজের অন্যতম প্রধান শিক্ষা হলো তাওহিদ বা একত্ববাদ। বরং বলা যায়, একত্ববাদই হজের প্রাণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা হজ ও ওমরাহ আল্লাহর জন্য সম্পন্ন করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৬) তাই হজ পালনকালে মহানবী (সা.) তাওহিদের বাণী প্রচার করেন। তাঁর বিদায় হজের ভাষণ এর সাক্ষ্য বহন করে।

ইখলাসের দোয়া
ধর্মকর্ম পালনে ইখলাস-ঐকান্তিকতা যেন অর্জিত হয়, লোক-দেখানো থেকে যেন দূরে থাকা যায়, সে জন্য প্রতিপালকের কাছে আকুতি প্রকাশ করতেন মহানবী (সা.)। তিনি এই দোয়া পাঠ করতেন, ‘হে আল্লাহ! এমন হজ চাই, যা হবে লোক-দেখানো ও রিয়া থেকে মুক্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৮৯০)

আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান
মহান আল্লাহ পবিত্র হজে তাঁর নিদর্শনসমূহকে সম্মান-শ্রদ্ধা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহ সম্মান করবে তাদের হৃদয়ের তাকওয়ার কারণেই তা করবে।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩২) তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) হজের আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রকাশ করেন।

অধিক পরিমাণে দোয়া করা
নিঃসন্দেহে দোয়া একটি অপরিসীম গুরুত্বের বিষয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়ার প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান ছিলেন। তিনি দোয়াকে ইবাদত সাব্যস্ত করেছেন। হজে রাসুল (সা.) অধিক পরিমাণে দোয়া করতেন। তিনি তাওয়াফের সময়, সাফা-মারওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে, আরাফায় উটের ওপর বসে হাত বুক পর্যন্ত উঠিয়ে দীর্ঘ দোয়া ও কান্নাকাটি করেছেন। আরাফার যে জায়গায় তিনি অবস্থান করেছেন, সে জায়গায় স্থির হয়ে সূর্য ঢলে গেলে নামাজের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়া করেছেন। এ ছাড়া মুজদালিফায় ও দুই জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে দীর্ঘক্ষণ দোয়া করেছেন।

হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের হজ সম্পন্ন করলে আল্লাহকে স্মরণ করো, যেমন তোমরা স্মরণ করো তোমাদের পিতাদের।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৫৬৪)

বিনয়, নম্রতা ও শান্তভাব
হজের সফরে রাসুলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করেন, যা তাঁর চারিত্রিক উৎকর্ষের প্রমাণ। তবে হজে তিনি প্রতিপালকের সামনে ছিলেন সমধিক বিনম্র, বিনয়ী, ক্রন্দনকারী, অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জনকারী। হজরত জাবের (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে কান্না শুরু করলেন, কান্নায় দুই নয়ন ভেসে গেল। অতঃপর তিনি তিন চক্কর ‘রমল’ করেন। এবং চার চক্কর হেঁটে চলে শেষ করলেন, সমাপ্তির পর তিনি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করেন, এর ওপর দুই হাত রাখেন এবং তা দিয়ে চেহারা মাসেহ করেন।’ (সুনানে বায়হাকি : ৫/৭৪)

ভারসাম্য ও মধ্যপন্থা অবলম্বন
কর্মে মধ্যপন্থাই উত্তম। এর বিপরীতে উভয় প্রান্তিকতাই অনুত্তম ও অবাঞ্ছিত। শুভ্র শরিয়তে এরই তাগিদ এসেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মধ্যপন্থা অবলম্বন করো, এ কথা তিনি তিনবার বললেন। কেননা যে ব্যক্তি ধর্ম বিষয়ে চাপাচাপি করে সে পরাভূত হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৯৭৮৬)

হজে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অবস্থা ও চরিত্রগুণের যে দিকটি সমধিক মূর্তিমান হলো তা এই ভারসাম্য ও মধ্যপন্থা।

হজে শিক্ষাদান
আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়েছেন। আর তিনি এই দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার পরিচয় দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হজ সফরে একজন শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি তাঁর সঙ্গীদের হাতে-কলমে হজের আহকামসমূহ শেখান। কেননা তিনি তাঁর সফরসঙ্গী হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সুবিধার জন্য হজের আগেই মানুষের মাঝে ঘোষণা দিতে বললেন। মদিনার বাইরে ‘জুলহুলাইফা’ স্থানেও পুরা এক দিন অবস্থান করলেন নবাগতদের অপেক্ষায়। কাউকে তাঁর সংস্রব থেকে বিমুখ করা হয়নি অথবা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়নি।

ওয়াজ ও উপদেশ
ওয়াজ-উপদেশ সংস্কারকদের দায়িত্বের একটি বড় অংশ, আল্লাহর পথে আহ্বায়কদের মূল পদ্ধতি। হজের সফরে রাসুলুল্লাহ (সা.) সমবেত সাহাবিদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন, যা ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণ নামে পরিচিত। বিদায় হজের ভাষণে তিনি উম্মতকে তাওহিদ, রিসালাত, সৎকাজের উৎসাহ, দুষ্কর্ম ও অকল্যাণ থেকে বারণ করেছেন।

কোরআন ও সুন্নাহর প্রতি আহ্বান
কোরআন ও সুন্নাহ ইসলামের মূল ভিত্তি। রাসুলুল্লাহ (সা.) হজের সফরে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে তা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘তোমার মাঝে দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা তা আঁকড়ে ধরবে, তোমরা বিভ্রান্ত হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুলের সুন্নাহ।’ (মুসনাদে আহমাদ)
লেখক : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনিস্টিটিউট, ঢাকা

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে