ইসলাম ডেস্ক: বলবীর সিং ও যোগেন্দ্র পাল বাবরি মসজিদ ভাঙার অগ্রসেনানী ছিলেন। ২৫ বছর আগে তারা দু’জন বাবরি মসজিদের গম্বুজের চুঁড়ায় ওঠে দু’হাতে চালিয়েছেন শাবল। তারা উভয়েই এখন মুসলিম। রেখেছেন দাঁড়ি। বলবীর সিং মুহাম্মদ আমির নাম ধারণ করেছেন বলে জানা যায়।
দীর্ঘ ২৫ বছর আগে বলবীর সিংহ ও তার বন্ধু যোগেন্দ্র পাল সাধারণ পরিবার থেকে শিবসেনার সক্রিয় কর্মী হয়ে বাবরি মসজিদের চূড়ায় ওঠে শাবল দিয়ে মসজিদের গম্ভুজ ভেঙেছিলেন। মসজিদ ভাঙার পর তারা পানিপথে গলে তাদেরকে দেয়া হয় সংবর্ধনা।
বাবরি মসজিদ ভাঙার পর বলবীর সিংহকে তার পিতা দৌলতরাম বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। মসজিদ ভেঙে বাড়ি যাওয়ার পর তার পিতা তাকে বলে, ‘বাবা আমাকে বললেন, হয় তুমি এই বাড়িতে থাকবে, না হলে আমি। তো আমিই বেরিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। আমার স্ত্রীও বেরিয়ে এল না। থেকে গেল বাড়িতেই।’
সে সময় ভবঘুরের মতো জীবন কাটিয়েছে বলবীর। লম্বা দাড়িওয়ালা লোক দেখলেই ভয়ে আঁতকে উঠতো বলবীর। বেশ কিছু দিন পর বাড়ি ফিরে জানতে পারে, বাবা দৌলতরাম মা'রা গেছে। বাবরি মসজিদ ভাঙার দুঃখেই দৌলতরামের মৃত্যু হয়েছে।
অতঃপর বলবীর পুরনো বন্ধু যোগেন্দ্র পালের খোঁজখবর নিতে গিয়ে আরও মুষড়ে পড়েন। বলবীর জানতে পারে, যোগেন্দ্র মসজিদ ভাঙার প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে মুসলিম হয়ে গেছে। যোগেন্দ্র পালের সঙ্গে দেখা হলে সে বলবীরকে বলেছিলেন, বাবরি ভাঙার পর থেকেই তাঁর মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। যোগেন্দ্রর মনে হয়েছিল পাপ করেছিলেন বলেই সেটা হয়েছে। প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে তাই মুসলিম হয়ে যান যোগেন্দ্র।
যোগেন্দ্র পালের কথা শুনেই বলবীর সিংহ দেরি না করে সোনেপতে গিয়ে মাওলানা কালিম সিদ্দিকির কাছে মুসলিম ধর্মে দীক্ষা নেন। মুহাম্মদ আমির নাম ধারণ করেন। লম্বা দাড়ি রেখে দেন। নিয়মিত ভোরে ফজরের আজান দেন। সব সময় আল্লাহর জিকির-আজকার করেন।
বলবীর সিংহের পরিবার
বলবীর বা তার পরিবার কোনো দিন উগ্র হিন্দু ছিল না। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর ইংরেজি, এই তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি পাওয়া বলবীর তাঁর মা, বাবা, ভাই, বোনদের নিয়ে ছোটবেলায় থাকতেন পানিপথের কাছে খুব ছোট্ট একটা গ্রামে। বলবীরের বয়স যখন ১০ বছর, তখন তার বাবা দৌলতরাম তার ভাইদের পড়াশোনার জন্য পানিপথে চলে আসে।
দেশ বিভাগ দেখা বলবীরের বাবা বরাবরই গাঁন্ধীবাদে (মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে) বিশ্বাসী ছিলেন। সে কারণেই তাদের আশপাশে যেসব মুসলিমরা থাকতো, উনি তাঁদের আগলে রাখতেন সব সময়। কিন্তু পানিপথের পরিবেশটা ছিল অন্য রকম। হরিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা লোকজন পানিপথে সেভাবে মর্যাদা পেত না।
এ দুঃখবোধ সব সময় বলবীরকে তাড়িয়ে বেড়াত। একদিন পানিপথের আরএসএসের একটি শাখার অচেনা, অজানা কর্মীরা বলবীরকে দেখে ‘আপ’ ‘আপ’ (আপনি, আপনি) বলে সম্বোধন করেন। সেটা বলবীরের কাছে খুব ভালো লেগেছিল। সেই থেকেই ওদের (আরএসএস) সঙ্গে বলবীরের পথচলা শুরু।
রোহতক মহর্ষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ সম্পন্ন করে সে সময়টিতে বিয়ে করে বলবীর সিংহ। প্রতিবেশীরা বলবীরকে কট্টর হিন্দু হিসেবে জানলেও বলবীরের বাবা ও তার পরিবার কখনোই মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করতো না। এমনকি মন্দিরেও যেত না। এমনকি তাদের বাড়ি থাকা গীতাও তার পরিবারের কেউ কখনো পড়ত না।
২৫ বছর আগে যখন বাবড়ি মসজিদ ভাঙার তোড়জোর শুরু হয় তখন শিবসেনার লোকজন তাকে ও তার বন্ধু যোগেন্দ্রকে বাবরি মসজিদ ভাঙতে অযোধ্যায় পাঠিয়েছিল।
বাবরি মসজিদ ভেঙে পানিপথে ফিরে আসার পর তাদেরকে দেয়া বিরাট সংবর্ধনা। বাবরি মসজিদের গম্বুজে শাবল চালিয়ে তারা সেখান থেকে দু’টি ইট এনেছিল, যা পানিপথের শিবসোর স্থানীয় অফিসে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল।
বাবরি মসজিদ ভেঙে বাড়ি আসার পর বলবীরের বাবা দৌলতরাম তাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। মসজিদ ভাঙার কারণে তার স্ত্রীও তার সঙ্গে যায়নি। বাবরি মসজিদ ভাঙায় বলবীরের বাবা দৌলতরাম যে দুঃখ পেয়েছিলেন তাতেই তার মৃত্যু হয়।
একদিকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়া অন্য দিকে পিতার মৃত্যু বলবীরে মনোকষ্টকে আরো বাড়িয়ে দেয়। অতঃপর বাবরি মসজিদ ভাঙার সাথী যোগেন্দ্র পালের মুসলিম হয়ে যাওয়ার কথা শুনে বলবীর আরো বেশি মুষড়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত বলবীর মুসলিম হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যেই কথা, সেই কাজ। বলবীর সিংহ মুসলিম হয়ে গেলেন। নাম ধারণ করলেন মুহাম্মদ আমির।
বলবীরের প্রতিজ্ঞা
বলবীর সিংহ প্রতিজ্ঞা কররেন, বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে ভারতে ভেঙে পড়া ১০০ মসজিদ সংস্কার করবেন। বলবীরের দাবি অনুযায়ী ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ ২৫ বছরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে মেওয়াটে অনেক ভেঙে পড়া মসজিদ খুঁজে বের করে সেগুলোর মেরামত করেছেন। মুহাম্মদ আমির আরো জানান, উত্তর প্রদেশের মেন্ডুর মসজিদও তিনি স্থানীয় মুসলিমদের সহযোগিতায় সংস্কার করেছেন।