মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা : আসমান-জমিন ও এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে, সব কিছু আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে। আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমন কিছু নেই, যা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তাদের এই তাসবিহ পাঠ সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করতে পারে না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘সাত আকাশ, পৃথিবী ও এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে, সব কিছুই তাঁর (আল্লাহর) পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। আর এমন কিছু নেই, যা তাঁর প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তোমরা তাদের পবিত্রতা ও মহিমাকীর্তন বুঝতে পারো না। অবশ্যই তিনি সহিষ্ণু, ক্ষমাশীল।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৪৪)
প্রাচীন তাফসিরবিদদের মধ্যে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি (রহ.) ও এক দল তাফসিরবিদ মনে করেন, সৃষ্টিজগৎ আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করার বিষয়টি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু ইমাম কুরতুবি (রহ.)সহ আরেক দল তাফসিরবিদ মনে করেন, গোটা সৃষ্টিজগৎ আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করার বিষয়টি বাস্তবিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁদের মতে, সৃষ্টিগতভাবে মহান আল্লাহ জগতের প্রতিটি অণু-পরমাণুকে তাসবিহ পাঠকারী বানিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা অনুধাবন করতে পারে না। এ থেকে জানা যায়, এই তাসবিহ পাঠ সত্যিকারের। কিন্তু তা মানুষের বোধশক্তি ও অনুভূতির ঊর্ধ্বে। ইমাম কুরতুবি (রহ.) তাঁর বক্তব্যের পক্ষে কোরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে দাউদ (আ.) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি (আল্লাহ) নিয়োজিত করেছি পর্বতকে, যাতে তারা সকাল-সন্ধ্যায় তার সঙ্গে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এবং সমবেত বিহঙ্গকুলকেও। সবাই ছিল তার অনুগত।’ (সুরা : সদ, আয়াত : ১৮-১৯)
আকাশ-বাতাস সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি দেখোনি যে আসমান ও জমিনে যারা আছে তারা এবং সারিবদ্ধ হয়ে উড়ন্ত পাখিরা আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে? প্রত্যেকেই তাঁর সালাত ও তাসবিহ জানে। তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবগত। (সুরা : নূর, আয়াত : ৪১)
বজ্র সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর বজ্র তার সপ্রশংস তাসবিহ পাঠ করে।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ১৩)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত, বজ্রধ্বনি শুনতে পেলে আলাপ-আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে বলতেন, ‘মহাপবিত্র সেই সত্তা বজ্রধ্বনি যাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং ফেরেশতাকুল যার ভয়ে শঙ্কিত।’ অতঃপর তিনি বলতেন, এটা হলো জগত্বাসীর জন্য চরম ভীতি প্রদর্শন বা হুমকি। (আদবুল মুফরাদ, হাদিস : ৭২৮)
ফেরেশতাদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তুমি ফেরেশতাদের আরশের চারপাশ ঘিরে তাদের রবের প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করা অবস্থায় দেখতে পাবে। আর তাদের মধ্যে ন্যায়সংগতভাবে বিচার করে দেওয়া হবে এবং বলা হবে, সব প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৭৫)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর ফেরেশতারা তাদের রবের প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করে এবং পৃথিবীতে যারা আছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে; জেনে রেখো, আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা : শুরা, আয়াত : ৫)
পাহাড়-পর্বত সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি পর্বতমালা ও পাখিদের দাউদের অধীন করে দিয়েছিলাম, তারা দাউদের সঙ্গে আমার তাসবিহ পাঠ করত। আর এসব আমিই করছিলাম।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৭৯)
চন্দ্র-সূর্য সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তিনিই রাত ও দিন এবং সূর্য ও চাঁদ সৃষ্টি করেছেন; সবাই নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৩৩)
বস্তুর ছায়া সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারা কি আল্লাহর সৃজিত বস্তু দেখে না, যার ছায়া আল্লাহর প্রতি বিনীতভাবে সিজদাবনত হয়ে ডান ও বাম দিকে ঢলে পড়ে।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৪৮)
পিঁপড়া সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত, একটি পিঁপড়া নবীকুলের কোনো নবীকে কামড়ে দিলে তিনি পিঁপড়ার বাসা সম্পর্কে বিশেষ হুকুম দিলেন, ফলে তা জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে এই মর্মে ওহি পাঠালেন যে একটি (মাত্র) পিঁপড়া তোমাকে কামড়ে দিল, তাতে কিনা তুমি উম্মত ও সৃষ্টিকুলের এমন একটি দলকে জ্বালিয়ে দিলে, যারা তাসবিহ পাঠ করছিল? (মুসলিম, হাদিস : ৫৬৫৪)
এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে গোটা পৃথিবী মহান আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে।