সুফিয়ান ফারাবী : নানা ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস আমাদের সমাজে। সম্প্রীতির মেলবন্ধনে আবদ্ধ আমরা পরস্পর। একাধিক ধর্মের মানুষ বসবাস করছি এক মহল্লায় এমনকি এক ছাদনাতলায়। পরিচয়ে আমরা সকলেই মানুষ ও বাঙালি। আমাদের চারপাশের মানুষগুলো সবাই এক রঙের নয়, এক পেশারও নয়।
প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় জীবিকা উপার্জন করে। কেউ হালাল বা বৈধ পথে, কেউ হারাম ও অ'বৈ'ধ পথে। জীবিকার তা'গিদে আমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বেঁছে নেয় অ'বৈ'ধ বা নি'কৃ'ষ্ট পেশা। তার মধ্যে একটি হলো দে'হব্য'বসা বা পতি'তাবৃত্তি। সমাজের কতিপয় নারী পতি'তাবৃত্তি বেছে নিতে বা'ধ্য হয় বলে আমার ধারণা। তাদের অধিকাংশের এ পথে আসার পেছনে একটি ক'রু'ণ বাস্তবতা থাকে।
যেই বাস্তবতাটা তাকে কখনো সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দেয়, কখনো তারা চক্ষু ল'জ্জায় পরিচিতদের থেকে দূরে সরে যায়। অধিকাংশ পতি'তা স'র্বহা'রা হয়ে পরিশেষে কোন একটি নি'ষি'দ্ধ পল্লীতে আশ্রয় খুঁ'জে নেয়। জন্মসূত্রে কেউ পতি'তা হয়ে জন্মায় না। এই স্বপ্ন নিয়েও কোন বালিকা বেড়ে ওঠে না। সমাজ ও বাস্তবতা তাকে নি'ষি'দ্ধ পল্লীতে নি'ক্ষে'প করে।
সেদিন রাত আনুমানিক দুইটার দিকে ঢাকা থেকে বাসায় ফিরছিলাম। নেমে দেখলাম, বাস স্টপেজের খানিকটা দূরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, এত রাতে মেয়েটির বাইরে কী কাজ? তার কি কোনো বি'প'দ হয়েছে? কারণ জানতে তার কাছে গিয়ে দেখলাম- মেয়েটার গায়ে জী'র্ণশী'র্ণ পোশাক। আধো'য়া কালো একটা চাদর গায়ে মোড়ানো। হাতে সি'গারে'ট। মুখভর্তি পান। একটু পরপর পিক ফেলছে।
আমার বুঝতে ক'ষ্ট হলো না এও সেই দলভু'ক্ত। পতি'তা বলে আমরা যাদের গা'লি দেই। মেয়েটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে আমি তার কাছে এ পথে আসার গল্পটা জানতে চেয়েছিলাম। মেয়েটি যা বলল তার সারমর্ম হল- ''সে একটি ছেলেকে ভালোবাসতো। ছেলেটিও তাকে ভালোবাসতো। দীর্ঘ তিন বছর শারীরিক সম্পর্ক ছিল তাদের মাঝে।''
ছেলেদের অর্থবিত্ত বেশ ভালো। সমাজে উঁচু জাতের লোক। অন্যদিকে মেয়েটির বাবা মা'রা যায় মেয়েটির চার বছর বয়সে। এরপর থেকে মানুষের বাসায় কাজ করে মেয়েটিকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়িয়েছিল তার মা। যায়যায়দিন অবস্থা তাদের সংসারে। তাই মেয়ের মা ম'ন'স্থির করলেন, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিবেন। অ'সু'স্থ শরীর নিয়ে মানুষের বাড়িতে আর কাজ করতে পারছেন না তিনি।
এখন মেয়েটিকে ভালো পাত্রস্থ করা ছাড়া উপায় নেই। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হলো। বিয়েও হয়ে গেল। কিন্তু ১৬ বছরের মেয়েটি ভালোবাসার আ'বে'গ ক'ন্ট্রো'ল করতে পারেনি। স্বামীর সঙ্গে দু'র্ব্য'বহার করে বাড়ি ফিরে আসে। মেয়েটি ভেবেছিল, ছেলেটির সঙ্গে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ততদিনে ছেলেটি কানাডা চলে গিয়েছে পড়াশোনার জন্য। মেয়েটির মাথায় আকাশ ভে'ঙ্গে পড়লো।
এদিকে মায়ের অসু'স্থতাও দিন দিন বাড়ছিল। অবস্থা এত দূর গিয়ে পৌঁছল যে, ঘর ভাড়ার টাকাটাও দিতে পারছিল না তিন মাস ধরে। মায়ের ওষুধের খরচ, ঘর ভাড়া, বাজারের টাকা কিছুই ছিল না তাদের কাছে। এ-কুল ও-কুল হা'রা মেয়েটি আস্তে আস্তে নি'ষি'দ্ধ পথের দিকে পা বাড়ায়।''
মেয়েটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে যখন বাড়ি ফিরছিলাম আমার মন থেকে দেহ-ব্যবসায়ীদের প্রতি ঘৃ'ণা কমে গেল, সহানুভূতি তৈরি হল। ভাবলাম এরাও মানুষ। এদেরও ধর্ম আছে। হ্যাঁ, অবশ্যই ধর্ম আছে। এমনকি অনেক লেবা'সধারীর চেয়েও এদের মনে আল্লাহর ভ'য় বেশি, সারাদিন যাই করুক, আজান শুনলে ওড়নাটা মাথায় টেনে নেয়, কোন আলেম ওলামা হাজি সাহেব দেখলে আ'ড়ালে চলে যায়।
হাদীস শরীফে স্পষ্ট আছে- যে ব্যক্তি কালিমা বলবে এবং এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালামের এ কথা শুনে সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, যদি সে ব্য'ভি'চার করে, তবুও কি সে জান্নাতে যাবে? বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবাদের বললেন, হ্যাঁ যদি সে যেনাও করে, তবুও সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (যদি এ বিশ্বাসের ওপর মৃ'ত্যুব'রণ করে)
সম্প্রতি রাজবাড়ির দৌলতদিয়ায় একজন যৌ'নকর্মীর ধর্মীয় রীতি মেনে দা'ফন ও জা'নাজার ঘটনা বেশ আলো'ড়ন তুলেছে। দীর্ঘদিনের প্রথা ভে'ঙ্গে একজন যৌ'নকর্মীর জা'নাজার ঘটনা তাদের প্রতি সামাজিক দৃ'ষ্টিভ'ঙ্গি বদ'লাতে কতটা কাজ করবে? আমাদের দেশে দেহ ব্যবসায়ীদের জানাজা পড়াতে চান না ক'তি'পয় অ'র্ধশি'ক্ষিত ইমামরা।
পতি'তাদের সামাজিক বয়'কটের চূ'ড়ান্ত পর্যায় হল এটি। অথচ সেসব অর্ধশি'ক্ষিত মোল্লারা ইসলামের উদা'রনী'তি সম্পর্কে বেখ'বর। এসব কা'ঠমো'ল্লারা আবার মাহফিল করে। সেখানে সামান্য টাকার লো'ভে প্রধান অতিথি বানায় ম'দখো'র, চাঁ'দাবা'জ, দুর্নী'তিবা'জদেরকে। কারণ তারা পয়সাওয়ালা।
কতিপয় এসব ধ'র্মমো'ড়ল বি'ত্তশা'লী ম'দখো'র, চাঁ'দাবা'জ, দুর্নী'তিবা'জদের জানাজা পড়ায় খুব গর্বের সঙ্গে। বলে বেড়ায়, অমুক নেতার জানাজা আমি পড়িয়েছি। তখন কোন ফতো'য়া আসেনা এদের মুখ থেকে।
প্রথা ভেঙে দৌলতদিয়ার একজন যৌনকর্মীর জানাজা পড়িয়ে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছিলেন যে মসজিদের ইমাম, তিনি বলছেন, তিনি ভবিষ্যতে আর কখনো কোনো যৌনকর্মীর জানাজা পড়াবেন না। দৌলতদিয়া রেলস্টেশন মসজিদের ইমাম গোলাম মোস্তফা বিবিসিকে বলছেন, হামিদা বেগমের জানাজা পড়ানোর পর তিনি স্থানীয়ভাবে স'মালো'চনার মুখে পড়েছেন।
বিবিসিকে তিনি বলছেন, ''এইখানে তো স'মালো'চনা হচ্ছে। গ্রামের লোক, দোকানদার সবাই আমার স'মালো'চনা করছে। এতোদিন জানাজা হয় নাই, আমি কেন হঠাৎ করে জানাজা পড়াইলাম? ভবিষ্যতে আর জানাজা পড়ানোর নিয়ত নাই। বিভিন্ন আলেমের সঙ্গেও কথা বলছি। তারাও নিষে'ধ করছে। পল্লীর লোকেরা অন্য কাউকে দিয়ে জানাজা, দা'ফন করাইতে পারে। কিন্তু আমাকে পাবে না।'' (বিবিসি বাংলা)
আমি হাজার বার বলবো, একজন সু'দখো'র, চাঁ'দাবা'জ, দুর্নী'তিবা'জ, আ'ত'ঙ্কবা'দীর চেয়ে একজন দে'হব্য'বসায়ী শতগুণে ভালো। তুলনামূলক সে আল্লাহর কাছে দামি। যদিও তার পা'পের শা'স্তি তাকে পেতে হবে। আর সেই শা'স্তি দিবেন মহান আল্লাহ তাআলা। আমরা বিচারক নই।
তাই সকলের প্রতি উদা'ত্ত আহ্বান রেখে বলবো, জানাজা হচ্ছে মৃ'ত ব্যক্তির জন্য দোয়া। সকল মুসলমানের জন্য জা'নাজা আদায় করা ফ'রজে কে'ফায়া। কিছু মানুষ আদায় করে দিলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আর যদি কেউ আদায় না করে তবে সকলকেই আল্লাহর কা'ঠগ'ড়ায় দাঁড়াতে হবে। জবা'বদি'হিতার জন্য।
পবিত্র বো'খারী শরীফে এসেছে, প্রত্যেক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের পাঁচটি হক রয়েছে। সালামের উত্তর দেয়া, কোন মুসলমান অসু'স্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া, মুসলমানের জানাজা আদায় করা, কেউ নিম'ন্ত্রণ করলে সাড়া দেয়া এবং কেউ হাঁচি দিলে তার উত্তর দেয়া।
সুতরাং, আসুন মানুষের কৃ'তকর্মের ফলাফল নির্ধারণ করার ক্ষম'তা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেই। বিচারকের চেয়ারটি আল্লাহর জন্য বরাদ্দ থাকুক। পতি'তাদেরকে দূরে ঠেলে না দিয়ে দ্বী'নের পথে ডাকি, তাদের সামনে সুপথ প্রদর্শন করি। মৃ'ত্যুর পর তাদের শেষ কর্মটি যথাযথভাবে পালন করি। মনে রাখবেন, কেবলমাত্র আলোই পারে অ'ন্ধকারকে মি'টিয়ে দিতে। সূত্র : যুগান্তর
লেখক: মুদাররিস, আরবি সাহিত্য ও ইসলামী ফিকাহ, জামিয়া মাহমুদিয়া সাভার ঢাকা।